একান্ত সাক্ষাৎকারে সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম

‘এটি আত্মহত্যা নয়, এটি ছিল প্রি-প্ল্যানড মার্ডার’

Sanchoy Biswas
জুলফিকার তাজুল, সিলেট
প্রকাশিত: ৪:৪৭ অপরাহ্ন, ২৩ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৪:৪৭ অপরাহ্ন, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

কারও কাছে স্বপ্নের নায়ক, কারও কাছে বাংলা সিনেমার রাজপুত্র, কেউ আবার তাকে নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে স্মার্ট নায়কের অভিধা দিয়ে থাকেন। তবে ক্ষণজন্মা এই নায়ককে যে অভিধাই দিই না কেন, তিনি আসলেই বাংলা চলচ্চিত্রের বাঁক বদলের ইতিহাস তৈরি করে গেছেন। যে কারণে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে পেয়েছেন অমরতা। তার পরিচয় একমাত্র তিনিই— মায়াবী চাহনির রোমান্টিক এই নায়ক সালমান শাহ।

তবে সালমান শাহর মৃত্যু ঘিরে রয়েছে রহস্যের জাল। সেটি এখনো কেউ উন্মোচিত করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় সালমান শাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তার অকালমৃত্যু নিয়ে তৈরি হয় রহস্যের জট। ২০২০ সালে তার ‘রহস্যজনক মৃত্যু’ নিয়ে চাঞ্চল্যকর এক মামলার তদন্তে ইতি টানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত করেনি পিবিআই— দাবি করে ২০২১ সালে নারাজি দিয়েছিলেন তার মা নীলা চৌধুরী। সম্প্রতি সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনায় আবার হত্যা মামলা করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আরও পড়ুন: অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের মা তাহুরা আলী আর নেই

মৃত্যুর ২৯ বছর পর ফের মামলা পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় আবার সালমান ভক্তরা আশা বুক বাঁধছেন যে, এবার তার মৃত্যুর রহস্য অবশ্যই উন্মোচন হবে। সম্প্রতি স্বপ্নের নায়কের মৃত্যু নিয়ে পিবিআই রিপোর্ট বিতর্ক ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে মুখ খুলেছেন সালমানের মামা আলমগীর কুমকুম। তার দাবি, “এটি আত্মহত্যা নয়, প্রি-প্ল্যানড মার্ডার।”

সালমান শাহর মামলা সম্পর্কে তার মামা আলমগীর কুমকুম বলেন, ‘সালমান শাহ ছিলেন চলচ্চিত্রের একটা ইন্ডাস্ট্রি। তার মৃত্যুর পর দেশে ৪০/৫০ জন তরুণ-তরুণী আত্মহত্যা করেছে। তার ভক্তরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। এত বড় এক সম্পদকে হারানোর পরও মামলাটা বছরের পর বছর ঝুলে রইল কেন?— এমন প্রশ্ন আমাদের ভেতরে দগদগে জ্বলছিল।’

আরও পড়ুন: দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গেও বিচ্ছেদ যা বললেন পূর্ণিমা

তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বিচারক মামলার সমস্ত উপকরণ পর্যালোচনা করে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয়, তার ভক্তদের জন্যও একটি বার্তা। এটি আল্লাহর হুকুমে এমনভাবেই হওয়ার ছিল। সালমান শাহর আত্মার শান্তির জন্য এই রায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরিবারের পাশাপাশি কিছু সালমানভক্তও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। তারা অনেক কিছু বের করেছেন। কিছু ছেলে আছে— ওরা সামিরার (সালমান শাহর স্ত্রী) সঙ্গে সম্পর্ক রাখত, গোপনে কথা বলত। কিন্তু পরে যখন সত্য জানতে পারে, তখন ওরাই সামিরার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ শুরু করে। ওরা এখন আমাদের পাশে। আমি নাম বলছি না, কিন্তু ওদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। ইনশাআল্লাহ, আমরা প্রমাণ করব— এটি আত্মহত্যা নয়, প্রি-প্ল্যানড মার্ডার।’

আলমগীর কুমকুম বলেন, ‘এখন আমাদের কোনো ভয় নেই। কোনো চ্যালেঞ্জ আমরা ফেস করছি না। আদালতের রায় এসেছে। মহামান্য আদালত বলেছেন— ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। এটা সালমান ভক্তদের রক্ত-চোখের প্রতিফলন।’

সালমান শাহর মামলা ঘিরে সবচেয়ে বড় বিতর্ক তৈরি হয় পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) রিপোর্টকে কেন্দ্র করে। সেই রিপোর্ট সম্পর্কে আলমগীর কুমকুম বলেন, ‘আদালত পিবিআইকে বলেছিল, পুনরায় তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে। কিন্তু পিবিআই কী করল? তারা সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে একটা ছেলে আর মেয়ে ফোনে কথা বলছে— এমন কিছু কাল্পনিক চার্ট বানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জনগণের সামনে প্রকাশ করে ফেলল। অথচ এটা আদালতে জমা দেওয়ার কথা ছিল! এভাবে প্রকাশ করা আদালত অবমাননার শামিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘বনজ কুমার মজুমদারের রিপোর্ট প্রকাশের পর সালমান ভক্তদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। কেউ কেউ আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন। এমন একটি দায়িত্বশীল সংস্থা কিভাবে এমনটি করতে পারে? এটা শুধু আদালতের প্রতি নয়, গোটা জাতির প্রতি অন্যায়।’ তার প্রশ্ন, ‘সালমানের মৃত্যুর সময় যে ফ্যান ব্যবহার করা হয়েছিল, সেই ফ্যান পিবিআই তদন্ত করেনি কেন? যদি সত্যিই আত্মহত্যা হয়, তাহলে সেই ফ্যানের ফরেনসিক টেস্ট করা হলো না কেন? এত প্রশ্নের উত্তর আজও কেউ দেয়নি।’

রুবি সুলতানা ও আদালতের জবানবন্দি নিয়ে আলমগীর কুমকুম বলেন, ‘রুবি সুলতানা আমাদের পক্ষের কেউ নন, তিনি সামিরার পক্ষের মানুষ। কিন্তু তিনিই প্রথম ফেসবুক লাইভে এসে সালমান শাহ হত্যার কাহিনি খুলে বলেছিলেন— তার সামনে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। পরে রিজভী নামের এক তরুণও একই কথা বলেছেন। তিনি ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। তাহলে এতকিছুর পরও কেন আগের বিচারকরা এসব উপেক্ষা করেছেন, তা আমরা আজও বুঝি না।’

তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘তবুও আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা কিছুই করব না, যা আইনের বাইরে। আমরা উপরের বিচারকের ওপর নির্ভর করি— তিনি আল্লাহ। আর আমরা দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, যেন সত্য উন্মোচিত হয়। আর সালমান শাহ হত্যার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।’

১৯৯৬ থেকে ২০২৫— প্রায় তিন দশক পেরিয়ে গেছে। সালমান শাহর মৃত্যুতে একটি প্রজন্ম হারিয়েছে তার স্বপ্নের নায়ককে, কিন্তু তার মৃত্যু নিয়ে সত্য খোঁজার লড়াই থামেনি কখনও। আলমগীর কুমকুম বলেন, ‘২৯ বছর পর অন্তত এটা বলতে পারি— আমরা এখন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। এ রায় আমাদের চোখে জল এনে দিয়েছে। কিন্তু সেই জল আনন্দের।’ তিনি যোগ করেন, ‘সালমান শাহ ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিপ্লবের নাম। তাকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে— আমরা তা প্রমাণ করব।’

রায় ঘোষণার পর এখন তারা নতুন করে প্রমাণ উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কুমকুম বলেন, ‘আমরা এখন কোনো তাড়াহুড়ো করছি না। আদালতের নির্দেশ মতো কাজ করছি। মহামান্য আদালত বলেছেন— ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে। এরই মধ্যে সেটা হয়েছে। এখন আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করছি।’

তিনি আশাবাদী, এবার সালমান শাহ হত্যার রহস্য পুরোপুরি উন্মোচিত হবেই। কুমকুম বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই। আমাদের পাশে থাকুন। সালমান শাহ শুধু আমাদের পরিবারের নয়, তিনি বাংলাদেশের তরুণ্যের প্রতীক ছিলেন। তার আত্মার শান্তির জন্য সত্য প্রকাশ পাওয়াটা সময়ের দাবি।’

উল্লেখ্য, প্রায় ২৯ বছর পর আদালতের নির্দেশে মামলাটি এখন হত্যা মামলা হিসেবে নিয়েছে পুলিশ। সোমবার গভীর রাতে (২১ অক্টোবর) রাজধানীর রমনা থানায় সালমান শাহর মায়ের পক্ষে মামলাটি করেন সালমান শাহর মামা আলমগীর কুমকুম। মামলায় যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তারা হলেন— সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, আজিজ মোহাম্মদ ভাই, লতিফা হক লুচি, খল অভিনেতা ডন, ডেভিড, জাভেদ, ফারুক, রুবি হক, রিজভী আহমেদ ফরহাদ, আ. ছাত্তার, সাজু ও অজ্ঞাতনামা আরও অনেকে। বাদীপক্ষের অভিযোগ, পরিকল্পিতভাবে সালমান শাহকে হত্যা করে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এদিকে নতুন করে মামলার খবরে সিলেটের দাড়িয়াপাড়ায় সালমান শাহর বাসভবনে ভিড় করছেন ভক্তরা। সবার দাবি একটাই— যেন প্রিয় নায়কের হত্যার রহস্য উন্মোচিত হয় এবং সুষ্ঠু বিচার হয়।