টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) এর ৭৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের টেকনাফ ব্যাটালিয়ন (২ বিজিবি) এর ৭৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর সকালে কক্সবাজারের টেকনাফে ২ বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়। রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহমেদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ব্যাটালিয়নের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কেক কাটেন। এ সময় টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল মোঃ আশিকুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তা, জুনিয়র কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদবীর সৈনিকবৃন্দ এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন: হাসিনার প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বাংলার সীমান্তে দুই শতাব্দীর গৌরবগাথা, ৪,৪২৭ কিলোমিটার সুদীর্ঘ সীমান্তরেখা, যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষিত হয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। স্বাধীনতার সূর্যোদয় থেকে আজ পর্যন্ত, দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় “সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী” আধুনিক, সুশৃংখল, অপ্রতিরোধ্য-বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। একাত্তরের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের উত্তরসূরি এই ব্যাটালিয়ন যাত্রা শুরু করে ১৯৪৮ সালের ২৭ অক্টোবর। আজকের এই দিনে ময়মনসিংহের খাগডহরে এই ব্যাটালিয়নটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ৭৭ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে, ৩৪ জন বীর সেনানীর রক্তে লেখা আমাদের মুক্তির গল্প। বহু সাহসী যোদ্ধা পেয়েছেন ‘বীর প্রতীক’ তাদের আত্মত্যাগ জ্বলজ্বল করে প্রতিটি সূর্যোদয়ে। ১৯৭৯-১৯৮০ সালে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই ব্যাটালিয়নের পাঁচ সদস্য শাহাদাত বরণ করে। ১৯৯৯ সালে অর্জন করে ‘বাংলাদেশ রাইফেলস্ স্ট্যান্ডার্ড পদক। অপারেশন দাবানল, পাঞ্চিং টাইগার, পূর্ব প্রাচীর—তিনটি ঐতিহাসিক অভিযানে লেখা বিজয়ের স্বাক্ষর। ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর টেকনাফের কৌশলগত ভূমিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিটি দিন ও রাত দেশপ্রেম, পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠার সাথে রক্ষিত হচ্ছে এই ভূমি। সততা, আনুগত্য, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা-২ বিজিবি'র প্রতিটি সদস্যের মূল ভিত্তি। সীমান্ত সুরক্ষা, জাতীয় স্বার্থ ও মাদকবিরোধী যুদ্ধ-প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাটালিয়ন হয়ে উঠেছে “জাতির গর্ব ও আস্থার প্রতীক”। বিজিবির ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র ইউনিট হিসেবে অত্যাধুনিক নজরদারি ব্যবস্থা স্থাপন করে ৩০ কিলোমিটার উপকূল এবং ২৩ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।
আরও পড়ুন: আগামী নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পুলিশ প্রস্তুত: আইজিপি বাহারুল আলম
মাদকের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধে ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮- টানা তিন বছর 'বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি' জয় করে গড়েছে অভূতপূর্ব কীর্তি। ক্রিস্টাল মেথ আইস ও ইয়াবার মতো মরণ বিষের বিরুদ্ধে নিরলস যুদ্ধে 'অপ্রতিরোধ্য শক্তি 'টেকনাফ ব্যাটালিয়ন' এর রয়েছে সাফল্যের অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মাত্র এক বছরে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন সফলভাবে ১৭৯ জন আসামি গ্রেফতার করেছে, উদ্ধার করেছে ২.০৮৮০৩ কেজি স্বর্ণ, জব্দ করেছে ৪.২০৬ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস, আটক করেছে ৫৭ লক্ষাধিক ইয়াবা ট্যাবলেট এবং নিষ্ক্রিয় করেছে দেশী-বিদেশী অস্ত্র- ০৩টি এ-৩ রাইফেল, ০৪টি এলজি, ০৪টি বিদেশী পিস্তল, ০৫টি ওয়ান সুটার গান-, ০৮টি রামদা, ০৮টি দেশীয় কিরিচ, ০২টি একনলা বন্দুক, ০৪টি চাকু, ০১টি চাপাতি ও ০১টি চাইনিজ কুড়াল। এছাড়াও উদ্ধার করা হয়েছে ০৪টি গ্রেনেড, ০১টি রকেট বোম্ব,৬৬৭ রাউন্ড তাঁজা গুলি, ০১টি কম্পাস, ০৪টি ম্যাগাজিন, ০১টি রকেট লাঞ্চারের গোলা, ০৪টি খালি ম্যাগাজিন, ০১টি প্লাষ্টিকের ম্যাগাজিন, ৬৯ টি হাত বোমা, ২.৯ কেজি বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি, ০১টি পিস্তলের গুলি, ০৬টি ওয়ান সুটার গানের গুলি ও ০২টি একনলা বন্দুকের গুলি।
টেকনাফ ব্যাটালিয়ন বিগত এক বছরে ২১৮ কোটি ২৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা মূল্যের মাদক ও চোরাচালান জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। মায়ানমারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ৩৪ জন নিরাপত্তা বাহিনীর নিরাপদ প্রত্যাবাসন ও নিরস্ত্রীকরণ নিশ্চিত করেছে। গত এক বছরে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন অপহরণকৃত ৩৮৭ জন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার এবং ৮৭ জন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে। বিজিবির নিরলস প্রচেষ্টায় আরাকান আর্মির নিকট আটককৃত ১২৪ জন বাংলাদেশি জেলে, কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ১৮টি নৌকা ও বিপুল পরিমান জাল ফেরত আনা হয়েছে।
এছাড়াও মানবিক সহায়তার অংশ হিসেবে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন ৪৪০ জনকে শীতবস্ত্র বিতরণ, ৮টি মেডিকেল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ১০৯৭ জনকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করেছে এবং বিভিন্ন সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রায় ১০০০ জন অসহায় মানুষকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, ‘‘যতদিন উড়বে লাল-সবুজ পতাকা, ততদিন বিজিবি দেশের সর্বদক্ষিণ সীমান্তের দুর্ভেদ্য প্রাচীর হিসেবে কাজ করবে।" প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে যাদের আত্মত্যাগে, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ টেকনাফ ব্যাটালিয়ন এই মর্যাদায় আসীন-তাঁদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা। আজকের এই দিনে আমারা নতুন করে আবার শপথ নিয়েছি আত্মপ্রত্যয়ী-সত্যবাদীতা ও ন্যায়-পরায়ণতার মধ্যে দিয়ে আমরা যেন আমাদের উপর অর্পিত যেকোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে পিছপা না হই। প্রয়োজনে দেশ মাতৃকার অখন্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিতে কুন্ঠাবোধ করবো না। দেশ মাতৃকার সেবায় নিরলসভাবে কাজ করে বিজিবি হবে 'সীমান্তের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতিক'।





