ঝটিকা মিছিল ও বিভিন্ন ইভেন্টে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা

সিটি ব্যাংকের এমডিসহ ইন্ধনদাতারা গোয়েন্দা নজরদারিতে

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৭:০৩ অপরাহ্ন, ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৭:৩১ অপরাহ্ন, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত ও রাজধানীসহ সারাদেশে অস্থিতিশীলতা তৈরিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, জাতীয় ধর্মীয় বিভিন্ন ইভেন্টে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। পলাতক ফ্যাসিস্ট সরকারের বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী ব্যাংকার সরাসরি ইন্ধন দিচ্ছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোর কমিটির বৈঠকে আলোচিত হয়েছে। ইন্ধনদাতাদের গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত রোববার অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের সাথে এই বিষয়টিও আলোচনায় আসে। আলোচনা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, সভায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের শান্তি ও সুস্থ ভোট প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য যে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা গ্রুপকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন: প্রতি ভরি ২২ ক্যারেটের দাম বেড়ে ২ লাখ ১৬ হাজার ৩৩২ টাকা

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি শারদীয় দুর্গাপূজা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে না হতে পারে, সেজন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করেছিল। কিছু ফ্যাসিস্ট বুদ্ধিজীবী ও ব্যবসায়ী এতে ইন্ধন যুগিয়েছিল, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে তাদের চক্রান্ত নষ্ট হয়ে যায়। এই ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক ঝটিকা মিছিল বৃদ্ধি ও জাতীয় বিভিন্ন ইভেন্ট এবং দাবি আদায়ের বিভিন্ন আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা তৈরির কৌশলের বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রতিবেদন দিয়েছে। এতে জানানো হয়, সারা দেশের পলাতক নেতাকর্মীরা ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। ভারতে শুনে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা পরিকল্পিতভাবে ঝটিকা ও প্রত্যাশিত মিছিল করছে। এছাড়াও পূজা সহ-সামাজিক ধর্মীয় বিভিন্ন ইভেন্টে অনুপ্রবেশ করে গোপন হামলা, ভাঙচুরের মাধ্যমে আন্দোলন তৈরির চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনের ঢুকে পড়ছে সচিবালয়, সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনাকে টার্গেট করে হামলা ও বিশৃঙ্খলার চেষ্টা। এক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাংক মালিক—এস আলম, ডাচ বাংলা ও সিটি ব্যাংক কর্মকর্তাদের ইন্ধনের খবর পাওয়া গেছে। সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী বিপু, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আফুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও উপদেষ্টা সালমান রহমানের অনুসারী ব্যবসায়ীরা সরাসরি অর্থ সহায়তা করছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে কর্মরত গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের আড়ালে পেশাজীবী পরিচয় নিয়ে বিভিন্ন ইভেন্টে ঢুকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।

আরও পড়ুন: ৯ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ঝটিকা মিছিল ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ইন্ধনদাতা অর্থ যোগানদাতাদের খোঁজা হচ্ছে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাবেক আইন মন্ত্রীর আত্মীয় শাহাবুদ্দিনের মালিকানাধীন ডাচ বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরিফিনের কক্ষে মাঝে মাঝে বিশেষ লোকদের নিয়ে বৈঠকের কথা শোনা যায়। পলাতক শেখ হাসিনার অতি ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত সিটি ব্যাংকের এমডির বিষয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সিটি ব্যাংকের গণসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা মির্জা ইয়াহিয়া এ বিষয়ে বলেন, ৫ আগস্টের পর সিটি ব্যাংকে এ ধরনের কোনো বৈঠক হয়নি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়মিত কাজ করছেন। তাকে তৃতীয় দফায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ অনেক আগেই হয়েছে।

গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী আর্থিক খাতে সংস্কার শুরু হলেও পলাতক শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ সহযোগীকে তৃতীয় দফায় সিটি ব্যাংকের এমডি নিয়োগ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এই নিয়োগের ফলে সিটি ব্যাংক স্বৈরাচারী দোসরদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে।

স্বৈরাচারী শাসনামলে একনাগাড়ে দুই দফায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকায় পুরো ব্যাংককে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠা করেছেন এমডি আরিফিন। তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পরিচালকদের সকল অপকর্মের বৈধতা দিতেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেকে লেখক, উপন্যাসিক পরিচয় দিলেও কার্যত শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার গুণগ্রাহী কিছু বই লিখে বিভিন্ন ক্লায়েন্টের মাধ্যমে সরকারের কাছে নিজেকে অতি ভক্ত হিসেবে প্রকাশ করতেন।

সিটি ব্যাংক সূত্র জানায়, মাসরুর আরিফিন ২০১৯ সাল থেকে টানা দুই মেয়াদে এমডি ও সিইও দায়িত্ব পালন করেছেন। তৃতীয় দফায় তার নিয়োগের পর ব্যাংক থেকে জানানো হয়, গত ছয় বছরে তিনি সিটি ব্যাংককে ভিন্নতর উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

মাসরুর আরিফিন ১৯৯৫ সালে এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে যোগ দিয়ে ব্যাংকিং পেশা শুরু করেন। ৩০ বছরের কর্মজীবনে তিনি এএনজেড ব্যাংক মেলবোর্ন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক কাতার, সিটি ব্যাংক এনএ, আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।

কিন্তু অনুসন্ধানে জানা গেছে, একমাত্র আওয়ামী কানেকশনের মাধ্যমে ছয় বছর আগে সিটি ব্যাংকে দায়িত্ব নেন বর্তমান এমডি। ক্ষতবিক্ষত ব্যাংকিং খাতকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করার চলমান পদক্ষেপে অনেক এমডি বাদ পড়লেও এই মাশরুর বহাল আছে। তার কথিত উপন্যাস ও লেখা পড়লেই বোঝা যায় কতটুকু স্বৈরাচারীর সহযোগী ছিলেন।

উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ দিয়ে রাজনৈতিক উত্থান:

সরকারের আস্থা অর্জনে ‘আগস্ট আবছায়া’ নামে লেখা উপন্যাসে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে রূপক আকারে তুলে ধরেন মাসরুর আরিফিন। তার লেখা তৎকালীন জাতীয় শোক দিবসে একটি দৈনিক পত্রিকার ক্রোড়পত্রে শীর্ষস্থানে ছাপা হয়। নজর কাড়েন শেখ হাসিনাসহ দলটির নীতিনির্ধারকরা। ২০১৮ সালে ডিএমডি থাকাকালেই তিনি উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’ লেখেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাসটি মূলত ২০১৫ সাল থেকে তার মাথায় আসে বলে জানিয়েছেন।

এমডি হওয়াসহ সরকারি উচ্চাবিলাসী সুবিধা আদায়ে ওই উপন্যাসকে হাতিয়ার বানান। ২০১৮ সালে যখন এমডি নিয়োগ নিয়ে সিটি ব্যাংকে আলোচনা চলছিল, তখনই বইটি প্রকাশ করেন এবং আলোচনায় আসেন। হাসিনা-ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য ‘আগস্ট আবছায়া’ রচনার পর শোক দিবসে পত্রিকায় মাসরুর আরিফিনের লেখা শীর্ষ সংবাদ স্থান পায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীর (কামাল চৌধুরী) ব্যবসায়িক পার্টনার সাহিদুল ইসলাম বিজুর সঙ্গে মাসরুর আরিফিনের ঘনিষ্ঠতার ফলে সুবিধা নেয়া সহজ হয়।

২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি সিটি ব্যাংকের এসডি হিসেবে নিয়োগ পান ‘আগস্ট আবছায়া’ লেখার সুবাদে। সেই ধারা এখনও ব্যাংকটিতে বিদ্যমান। পরবর্তীতে দুর্নীতিবাজ কাজী নাবিলের জেমকন গ্রুপের সাহিত্য পুরস্কার (২০২০), সালমান এফ রহমানের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংক আইএফআইসি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) ও ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার বাগিয়ে নেন।

এই সাহিত্যকর্মের পর ব্যাংকপাড়ায় তাকে ঘিরে তৈরি হয় এক ধরনের ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ ভাবমূর্তি। তিন মেয়াদে সিটি ব্যাংকের এমডি পদে পুনর্নিয়োগ এবং ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এবিবি) চেয়ারম্যান হওয়ায় সবকিছু মিলিয়ে তার একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে, স্বৈরাচারের দোসরদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করে সিটি ব্যাংক।

সিটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডে গত দেড় দশকে প্রায় একচেটিয়াভাবে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাই জায়গা পেয়েছেন। ব্যাংকটির নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব দৃশ্যমান।

গত ২৭ জুলাই আজিজ আল কায়সার টিটুকে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক ও ভাইস চেয়ারম্যান, আনোয়ার গ্রুপের হোসেন খালেদকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। নতুন চেয়ারম্যান হওয়ার আগেই আগের কমিটি মাসরুরকে এমডি নিয়োগ দেয় আরও তিন বছরের জন্য।

সিটি ব্যাংক এখন আর কেবল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়; এমডির প্রভাবে এটি এখন পতিত আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক পরিপূরক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মাসরুর আরিফিন এ রাজনৈতিক-ব্যাংকিং মেলবন্ধনের কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। ভারতে পলাতক খুনিদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগসহ দেশে নাশকতা তৈরি ও ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা তৈরিসহ নানা ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার উদ্বেগও প্রকাশ করেছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় অঙ্কের ঋণসুবিধা প্রদান থেকে শুরু করে দলের ডোনার প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছেন এ সিটি ব্যাংককে। ব্যাংকটি সর্বশেষ শেখ মুজিবুরের জন্মশতবার্ষিকীতে বড় ধরনের বরাদ্দ ছাড়াও কোটি কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে সাধারণ মানুষের আমানত থেকে। এসব নিয়ে কোনো বাক্য প্রয়োগের মতো পরিবেশ রাখেনি ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ছিল নিষ্ক্রিয়।