বিশ্লেষকরা বলেছেন, বিশেষ সুবিধা নিতে এসব দল গঠন করা হয়েছে

ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা প্রায় সব দলই নামসর্বস্ব

Rashedul Hoque
বাংলাবাজার রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৯:৫১ পূর্বাহ্ন, ২৫ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১০:২৯ পূর্বাহ্ন, ২৬ জুন ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য ১৪৭টি রাজনৈতিক দল আবেদন করেছে। এর মধ্যে প্রায় সব দলই অপরিচিত ও নামসর্বস্ব। এমনও দল রয়েছে, নেই কোনো কেন্দ্রীয় কার্যালয়। কোনো দলের কার্যালয় আসলে ভাতের হোটেল, কোনোটার ট্রাভেল এজেন্সি, কোনটির বাসার ঠিকানায় দেওয়া হয়েছে কার্যালয়ের ঠিকানা। স্বামী-স্ত্রী মিলে কমিটি গঠন করেও জমা দেওয়া হয়েছে।নির্ধারিত ফরমে আবেদন করেনি এমন দলও রয়েছে বেশ কয়েকটি। বিশ্লেষকরা বলেছেন, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বিশেষ সুবিধা নিতে এসব দল গঠন করা হয়েছে।  

ইসিতে নিবন্ধন চেয়ে গত ১৭ই এপ্রিল আবেদন করেছে বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণময় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান মো. শিপন ভূঁইয়া পেশায় চশমা ব্যবসায়ী। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনগণের খেদমত করতে দল গঠন করেছি। নিবন্ধন পাবো কিনা জানি না। এখন পর্যন্ত দুই জায়গায় অফিস নিতে পেরেছি। ঢাকার প্রধান কার্যালয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্টোর রুমের ঠিকানা প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করেছি। এছাড়া দলটি কবে গঠন করা হয়েছে- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিতে পারেননি। নিবন্ধনের শর্ত না মেনেই আবেদন করা আরেকটি দল বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ফেডারেশন। দলটির সভাপতি সিপনচন্দ্র সিং বলেন, আমরা ১৭-১৮টি জেলায় কমিটি দিতে পেরেছি। সবমিলিয়ে ৩৯টি  জেলা-উপজেলায় কমিটি দিতে পেরেছি এবং ভোটার তালিকা দিতে পেরেছি। হেয়ারিংয়ের সময় আমরা বাকি শর্তগুলো পূরণ করার তথ্য ইসিতে জমা দেবো। 

আরও পড়ুন: বাধ্যতামূলক অবসরে ডিএমপির সাবেক ৯ ওসি

জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। তারা নয়াপল্টনের ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলাকে দলীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে। ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে ‘আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’সহ বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি ও অন্য চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে।


আরও পড়ুন: হাসিনার প্রিজম দিয়ে বাংলাদেশকে দেখায় ভারতকে মূল্য দিতে হচ্ছে

ইসিতে জমা দেওয়া আবেদনে দলটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. কামরুজ্জামানের নাম উল্লেখ রয়েছে। আবেদনে উল্লেখিত মুঠোফোন নম্বরে কল করা হলে মো. কামরুজ্জামান  বলেন, ‘আগে তো সবকিছু সিস্টেম অনুযায়ী করতে হয়। সে জন্য আল আমিন ট্রাভেলসকে আমরা অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছি। নিবন্ধনের আবেদন করতে তাড়াতাড়ি এই ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে অফিস নেব।’


নয়াপল্টনের ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের ৫৩ নম্বর বাড়িটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি নামে একটি দল। সেই ঠিকানায় গিয়ে পুরো ভবনে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

ওই ভবনের ষষ্ঠ তলায় গিয়ে একটি কক্ষে সংস্কারকাজ চলতে দেখা গেছে। সেখানে মো. জিসান নামের একজন মাসুদ মিয়ার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে জানান, এখানে ট্রাভেল অ্যান্ড রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস হবে। নাম অভি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। রাজনৈতিক দল হবে কি না, তা জানেন না।

দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক সড়কের ১০২/৪ নম্বর বাড়ির পাঁচতলাকে দলের কার্যালয় দেখিয়ে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে ‘জাস্টিস ফর হিউমিনিটি পার্টি’ নামে একটি দল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন পরিস্থিতি।

মূল সড়ক থেকে সরু গলির ভেতরে ঢুকে ৪-৫টি বাড়ি পেরোলে ১০২/৪ নম্বর বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এটি সুউচ্চ নয়; বরং এটি একটি আধা পাকা একতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে ঝোলানো হোল্ডিং নম্বর দেখে ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুই কক্ষের এই বাড়িতে একটি পরিবার ভাড়া থাকে। তবে ভবনের সামনে রাজনৈতিক দলের কোনো সাইনবোর্ড নেই।

রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য গত ২৯ মে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস)। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানায় দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডির ক্রিসেন্ট রোডের একটি বাড়ি। ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. হাসানের ছেলে এই বাড়িতে থাকেন। বাড়ির তৃতীয় তলায় ছেলের বাসার ড্রয়িংরুম দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ধানমন্ডির গ্রীন লাইফ হাসপাতালের ঠিক পাশেই ক্রিসেন্ট রোড। রাস্তা ধরে দুই–তিন মিনিট ভেতরে এগোলেই ডান হাতে একটি গলি। গলির শেষ প্রান্তে ‘১৩১/১, এ’ নম্বর বাড়ি। এই বাড়ির তিনতলায় বাংলাদেশ বেকার সমাজের (বাবেস) কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

এদিকে গত ১২ই মার্চ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন পার্টি (বিএনএলপি)। নির্ধারিত ফরমে আবেদন না করে সাদা কাগজে আবেদন করেছে দলটি। দলটির সভাপতি মো. আবু তাহের খন্দকারের কাছে দলের কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃহত্তর রংপুর বিভাগ নিয়ে আমরা কাজ করি। আমাদের ৮টি জেলায় কার্যক্রম রয়েছে, ২১টি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা বা কমিটি দেয়ার মতো সক্ষমতা নেই। আমার বড় ভাই সংগঠনটি দাঁড় করেছিল। আমরা সেটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা নির্ধারিত ফরমে আবেদন করিনি। এছাড়া ন্যাশনাল লেবার পার্টি (এনএলপি) আবেদনের সবগুলো শর্ত পালন না করেই আবেদন করেছে। তারা ৮৭টি উপজেলার তথ্য দিয়েছে। এ বিষয়ে দলটির চেয়ারম্যান বলেন, বাস্তবতা হলো- আমরা এখনো পুরো উপজেলায় কাজ করতে পারিনি। তবে কাজ চলমান আছে। ৮৭টি উপজেলা এবং ২০টি জেলায় কমিটি দিতে পেরেছে এখন পর্যন্ত। নির্বাচন কমিশনে আবেদন করা দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবেদন করা অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই সম্পূর্ণ শর্ত মেনে আবেদন করেনি। 

ওদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে চাইলে তিনটি শর্তের যেকোনো একটি পূরণ করতে হবে। প্রথমত, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত কোনো সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে কমপক্ষে একটি আসনে বিজয়; দ্বিতীয়ত, ওইসব নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা যেসব আসনে অংশ নিয়েছেন, সেসব আসনে মোট ভোটের পাঁচ শতাংশ ভোট প্রাপ্তি; তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় অফিস থাকতে হবে। দেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলায় জেলা অফিস থাকতে হবে। আর অন্তত ১০০টি উপজেলা বা মেট্রোপলিটন এলাকার থানায় অফিস থাকতে হবে, যার প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে কমপক্ষে ২০০ জন ভোটার থাকবে। দলীয় প্যাডে দরখাস্তের সঙ্গে দলের গঠনতন্ত্র, নির্বাচনী ইশতেহার (যদি থাকে), দলের বিধিমালা (যদি থাকে), দলের লোগো ও দলীয় পতাকার ছবি, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের নামের তালিকা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সর্বশেষ স্থিতি জমা দিতে হবে। আবেদন পাওয়ার পর নির্বাচন কমিশন তা যাচাই-বাছাই শুরু করবে। নিবন্ধন শর্ত পূরণ করতে পারলে দলীয় প্রতীকসহ নিবন্ধন সনদ দেবে।

এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল দেশের জন্য ভূমিকা রাখতে নিবন্ধন করতে চায়। তবে বেশির ভাগ দলই রাজনৈতিক দলের দোকান খুলে বড় দলের আশ্রয়ে দুই-একটি আসন বাগিয়ে নিতে চায়। এছাড়া অনেকে আলোচনায় আসতেও নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। মিডিয়াতে আসলে তারা সেগুলো আত্মীয়-স্বজনকে দেখায়। 

এদিকে রেকর্ডসংখ্যক দলের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন বিশ্লেষক ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আব্দুল আলীম বলেন, জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করার কথা বলা হচ্ছে। এমনও হতে পারে এই সময়ে নির্বাচন কমিশনের উপরে একটি চাপ প্রয়োগ করার জন্য এত আবেদন করা হচ্ছে। কেননা আবেদন যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সময় সাপেক্ষ। আবার এটা নাও হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনের মতো কিছু রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পায়নি। তারা এতদিন রাজনীতি চর্চা করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে এখন যেহেতু একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, এজন্য অনেক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। তিনি আরও বলেন, অনেক রাজনৈতিক দলই আছেন যারা নিবন্ধন নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে দুই-একটি সিট নিতে চায়। অনেক সময় নির্বাচন থেকে সরে গেলেও টাকা আয় করা যায়। এজন্য অনেক রাজনৈতিক দল গঠন করা হতে পারে বলেও জানান তিনি।