রাজনীতিতে নির্বাচনমুখী তৎপরতা

AK Azad
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:১৮ অপরাহ্ন, ২৯ জানুয়ারী ২০২৫ | আপডেট: ৫:৩০ পূর্বাহ্ন, ৩০ জানুয়ারী ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ওয়ান ইলেভেনে সৃষ্ট আর্মিব্যাক ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান লে. জেনারেল মঈন উ আহমেদ সমন্বয় গড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রায় আড়াই বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিজ্ঞতাটা মোটেও ভাল ছিলনা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের।  

৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পতনের পর ৮ আগষ্ট গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ নিয়ে এক ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে। কী হবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল মাঠে নামানোর চিন্তার পাশাপাশি বিদেশীদের অব্যাহত চাপ, দেশেও বিএনপিসহ সমমনা যারা বিগত ১৬ বছর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর লড়াইয়ে নিষ্পেষিত হয়ে আসছিল গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য- সেসব দলের দাবির প্রেক্ষিতে অবশেষে বরফ গলতে শুরু ড. ইউনূস সরকারের।

সদ্য সুইজারল্যান্ড সফর করে ফিরেছেন দেশে। এর আগে সফররত অবস্থায় বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াবের এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, দেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, প্রক্রিয়াটি কেমন হবে। তারা কী ছোট পরিসরে সংস্কারে যাবে নাকি দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কার চাইবে। যদি মানুষ দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষনাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ নিয়েছি। আর যদি বলে, না আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের অরো ৬ মাস সময় লাগবে।  

তিনি আরো বলেন, সরকার নির্বাচন আয়োজনের অপেক্ষায় রয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস বিষয়টি ক্লিয়ার করেছেন বলেই শেষ নয়, এর আগেও বিভিন্ন মহল থেকে রাজনৈতিক দলগুলো যেসব আভাস পেয়েছেন, সে সূত্র ধরেই ভোটের মাঠে তীক্ষè দৃষ্টি এখন তাদের। উঁকিঝুকি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে অংশ নেয়ার আভাস দিচ্ছেন তারা বিভিন্ন মাধ্যমে এবং নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকারটাও যাতে লাভ করতে পারেন সে দাবীও আছে তাদের। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে কি না সেটা অনেক পরের কথা। তবে তাদের জোট রেডি। ১৬ বছর যাদের নিয়ে সুখী সংসার করেছে, তারাও নির্বাসিত আওয়ামী লীগের ন্যায়। ফলে ভোট করার ক্ষমতা পেলে তারাই থাকছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এটাই বাস্তবতা।
তবে সহসাই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এ সূত্র ধরেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকা ছাত্র ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ নতুন প্লার্টফর্ম খোঁজার চেষ্টায় মত্ত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কিছুদিন পরই এ ব্যাপারে ছাত্র নেতাদের প্রশ্ন করা হলে তারা এড়িয়ে যান এবং এমন কোনো রাজনৈতিক দল বা প্লার্টফর্ম গঠনের চিন্তার কথাও নাকচ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকা নেতৃবৃন্দ অনুধাবনে সক্ষম। দেশে তাদের মত প্রতিষ্ঠা এবং যে লক্ষ্যে তারা আন্দোলন করেছেন সেটা বাস্তবে রুপ দিতে রাজনৈতিক প্লাটফর্মের বিকল্প নেই। কারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান হলে পুরানো সেই রাজনৈতিক দল সমুহই সরকার গঠনে চলে আসবে। এবং দিন শেষে দেশ বিগত সময়ের মতই পরিচালনা শুরু হবে। যে বৈষম্যের জন্য এতগুলো ছাত্র জনতা প্রাণ দিয়েছে বা পঙ্গুত্ববরন করেছে তাদের সে রক্ত ও আত্মদান বৃথায় যেতে পারে।

জানা গেছে ফেব্রুয়ারিতেই আসছে তরুনদের রাজনৈতিক দল, যেখানে থাকবে অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের সংমিশণ। এদিকে, রাজনৈতিক অন্যান্য দলগুলোও তাদের প্রস্তুতি পূর্ণদ্যমে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগকে আপাতত মাইনাসে রেখে- বিএনপি, জামায়াত ইসলামীকে কেন্দ্র করেই এসব প্রস্তুতি। বিএনপি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই একটা জোট নিয়ে আন্দোলন করে আসছিল। যেখানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা করেছিলেন, নির্বাচনে বিজয়ী হলে আওয়ামী বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে যারাই যুক্ত থাকবে তাদের নিয়ে তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠন করবেন। বিএনপি এখনও সে কথাতেই রয়েছে। তবে বিএনপির ওই জোটে জামায়াত থাকবে কি-না এমন প্রশ্নে বিএনপি কৌশলে এড়িয়ে গেছে। সে থেকে জামায়াত বুঝতে পেরেছে বিএনপির মনোভাব!

আওয়ামী লীগের সময়ে আন্দোলনে বিএনপি কর্মসূচি দিলে সেটা অধিকাংশ সময় জামায়াতও সমর্থন দিয়ে কখনও কখনও মাঠে নামতো, তাদের নিজস্ব ব্যানারে। কখনও কৌশল খাটিয়েছে, চুপও দেখেছে তারা। ২৮ অক্টোবর বিএনপির পল্টনে যে মহাসমাবেশ ছিল, সেটাতে জামায়াত বিভিন্ন পয়েন্টে বিএনপি সমমনারা আন্দোলন সমাবেশ করলেও জামায়াত শেষ মুহুর্তে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু বিএনপির মহাসমাবেশ পন্ড করে দেয় পুলিশ ব্যাপক টিয়ারশেল, লাঠিপেঠার মাধ্যমে। কিন্তু নটরডেম, আরামবাগ এলাকায় জামায়াতের সভায় পুলিশ কোনোধরনের বিঘ্ন ঘটায়নি। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনাও চলে। দুইয়ের দুরত্বে ওই একটা পর্যায়ই।

পরবর্তিতে গণঅভ্যুত্থান। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের সূচনা থেকে জামায়াত বিএনপি থেকে যে দুরে অবস্থান করছে সেটা ক্লিয়ার করে এবং সে থেকেই দুই দল দুইমেরু থেকে জোট গঠনের পরিকল্পনা করে এগুচ্ছে। যা বাস্তবে রুপ নিচ্ছে এ মুহুর্তে। বিএনপি পুরানো ধারাতেই। তবে স্পষ্ট করছে জামায়াত। আওয়ামী লীগের অনুপুস্থিতি ধরে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের আর্ভিভূত করাই তাদের বিশেষ লক্ষ্য। আর সেটা করতে চান তারা নিজেদেরে সৎ, সততা, ইসলামী ভাবধারায় সমন্বিত রেখে। এতে বিশেষ করে ইসলামী দলসমুহকে একত্রে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। ইতিমধ্যে সফলও। চরমোনাইপন্থী ইসলামী দল- ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনকে আয়ত্তে নিয়ে আসতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এটা জামায়াতের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ। চেষ্টা করছে তারা আরো ইসলামপন্থী ও মাদ্রাসাভিত্তিক দলসমূহকে টানার। কিন্তু সবস্থানেই যে সফল হবে সেটাও না। কারণ, ইতিমধ্যে জামায়াতকে কোনোরকম পাত্তাই দিতে চায় না হাটহাজারী কেন্দ্রিক হেফাজতে ইসলামকে। বিশেষ করে কওমী মাদ্রাসাপন্থীরা জামায়াতের ব্যাপারে কট্টর ভূমিকায়। এমনকি জামায়াতকে ইসলামী কোনো দল হিসেবেও মানতে চান না তারা।
 
জামায়াত তার চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। বিএনপিও জামায়াতের এমন তৎপরতায় বসে নেই। চষে বেড়াচ্ছে ইসলামপন্থী অন্যসব দলকে পূর্বের ন্যায় কাছে টানার লক্ষ্যে। ইতিমধ্যে দলের পক্ষ থেকে এসব দলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার পাশাপাশি আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে। আলোচনা করেছে তারা চরমোনাইভিত্তিক ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও। সেখানে নিজেদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী রাষ্ট্রপরিচালনায়, সেটাও জানান দিয়েছে- ঐক্যমতের ভিত্তিতে।
জামায়াতের টার্গেট দুটি : এক আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মাঠে নামতে না দেয়া ও বিএনপিকে প্রতিহত করে যতটা পারা যায় সফলতা ঘরে তোলা। কিন্তু বিএনপি আওয়ামী লীগের ভোটের কাঙ্গাল। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে ভোটেও সুযোগ দেয়ার পক্ষপাতি। দলটি মনে করে আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করবে। কিন্তু এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ যেন সুর তুলতে না পারে যে তারা মাঠে থাকলে বিএনপি জিততে পারতো না, বা এত বিশাল পরিমাণ সিটও পেত না। কাজেই দেশের একটি বৃহৎ দল বাইরে রেখে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিএনপি মনে করে এমনিতেই পাস করে যাবে। তবে আওয়ামী লীগ যে অপকর্ম করেছে, মাঠের ভোটে তাদেরকে যেন জনগণ প্রত্যাখান করে দেখিয়ে দেয় তারা ভোটের দাবীদার হতে পারে না। কারণ তারা গণতন্ত্র হত্যাকারী।

এছাড়াও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতা নতুন দল গঠন করলে তাদের দলও নতুন জোট গড়ে কি না, সেটাও চিন্তার বিষয় বিএনপি জামায়াতের। কারণ সেখানে যদি ড. মুহাম্মদ ইউনুস, আসিফ নজরুলের মত মানুষ এবং সুশীল সমাজের আরো কেউ ভিড় জমায় তাহলে সেটা ত্রিমুখী এক ভোটের লড়াই অনুষ্ঠিত হবে। যা অনেক আগ থেকেই সতর্ক করে আসছেন নিজ দলের কর্মীদের বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সম্প্রতি বড় আলোচনা ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনকে ঘীরে। আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে অনেকটাই বিএনপির সঙ্গেই মিল রেখে এগিয়েছে তারা। এখনও সে ধারায়। মাঝে জামায়াত তার ইসলামপন্থী ভাবধারায়
নিয়ে আসার পরিকল্পনায় বৈঠক করার পর বিএনপিও অমন এক বৈঠক সেরেছে। সেখানে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত সময়ে জাতীয় নির্বাচনে পাশাপাশি ইসলামী শরিয়াহ বিরোধী সিদ্ধান্ত না নেয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ এবং জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি।

গত সোমবার দুপুরে ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ আমীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীম চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘আজকে ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ এর আমীর মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করীম সাহেবের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। এই আলোচনায় আমরা মোটামুটি ১০টি বিষয়ে একমত হয়েছি।”

ইসলামী শরিয়াহ বিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া এবং ইসলাম বিরোধী কোনো কথা কেউ বলবে না... এই ব্যাপারে দুই দলই ঐক্যমত প্রকাশ করেছে।

ইসলামী আন্দোলনের আমীর সৈয়দ রেজাউল করীম বলেন, ‘‘যে কথাগুলো আমাদের হয়েছে...আমরা তাদের সাথে, আমাদের সাথে এবং দেশ, মানবতা এবং রাজনীতির ব্যাপারে...এগুলো বিএনপি মহাসচিব তিনি আপনাদের (গণমাধ্যমে) উপস্থাপন করেছেন। এগুলো আমাদেরও কথা।”

এতে করে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন কার এ প্রশ্ন স্পষ্ট হতে আরো সময় লাগবে। এভাবেই নির্বাচনী মাঠের হিসেব নিকেষ শুরু, চলছে অনবরত।