বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা
জুলাই অভ্যুত্থানের জেরে বিপর্যস্ত পুলিশ বাহিনীকে ধীরে ধীরে গুছিয়ে এনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। তবে এ নিয়ে পর্যবেক্ষক মহল বা জনমনে স্বস্তি এখনও ফেরেনি। এমন অবস্থায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। কার্যকর নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সম্ভাব্য নেতিবাচক তৎপরতা, জামিনে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর মতবিরোধ, লুট হওয়া অস্ত্র এখনও উদ্ধার না হওয়া- এসব মিলিয়ে নির্বাচন পূর্ব সময়ে উত্তেজনা ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিশেষজ্ঞ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে ওপরের চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন শুরু থেকে কঠোর অবস্থান নিতে পারলে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। অন্যথায় তা অবনতির দিকে যেতে পারে। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একই দিনে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত গণভোট নেয়া হবে। গত বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন তফসিল ঘোষণা করার পর তরুণদের দল এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী একে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এ সময় অভিযোগ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট বাহিনীর উদাসীনতা রয়েছে, অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যাচ্ছে। এর ২৪ ঘণ্টা না যেতেই গত শুক্রবার দুপুরে রাজধানীতে দুর্বৃত্তের হামলার শিকার হয়েছেন নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদি। মাথায় গুলি লাগার পর বাঁচা-মরার সন্ধিক্ষণে রয়েছেন এই জুলাই যোদ্ধা। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সক্রিয় আছেন। তারা যে কোনোভাবে নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করতে পারে। এমন আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট মহলে রয়েছে। ইতিমধ্যে দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এক বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হলে তা প্রতিহত করা হবে। এ প্রতিহত করার জন্য দলটি তফসিল ঘোষণার পর বড় ধরনের কর্মসূচি বা সহিংস কার্যক্রমের পথে যেতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। নির্বাচন চলাকালে বড় ধরনের নাশকতা বা সংঘর্ষের ঝুঁকি রয়েছে। তবে ইসি এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন সিইসি। তিনি সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, কেউ নির্বাচন বাধা কষ্ট করার চেষ্টা করলে প্রয়োজনে ব্যবস্থা না হবে। শুধু কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ নয়, অন্যান্য দল সংশ্লিষ্ট বিষয় পরিস্থিতি অস্থির করতে পারে। বিএনপি ও জামায়াতের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব অন্যান্য দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন জোট গঠনও মতবিরোধও জটিলতা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম মনে করেন, বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মানদণ্ড অনুযায়ী পর্যাপ্ত নয়; তাই তাফসিলের পর ইসিকে আরও কঠোর ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের দিনে দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়। এসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। প্রায় ১০০০ অস্ত্র এখনো বেহাত রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’-এর সক্রিয় হয়ে ওঠার ব্যাপারে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারাগার থেকে মুক্তি পান বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। যারা রাজধানীসহ সারা দেশে সক্রিয় রয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এখনো অস্ত্র চোরাচালান চলছে। সন্ত্রাসীদের দমনে এবং অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অবিলম্বে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২’ চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। একইসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা আবেদন করলে তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে। গতকাল শনিবার আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘ওসমান হাদির ওপর আক্রমণের ঘটনা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াস বলে আমরা মনে করি। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত বা বানচাল করার যেকোনো ধরনের অপচেষ্টা অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হস্তে দমন করবে।’ নির্বাচনে প্রার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা জানান জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, তারা যদি অস্ত্র চান, তবে তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে। আর যে সমস্ত প্রার্থীর অস্ত্র সরকারের কাছে জমা রয়েছে, সেগুলো তাদের ফেরত দেওয়া হবে।’ তিনি আরও জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার বদ্ধপরিকর। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: সাক্ষী বিড়ম্বনায় পুলিশ
লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে। এটিকে আরও জোরদার ও বেগবান করার জন্য এবং সন্ত্রাসীদের দমনের উদ্দেশ্যে কমিটি ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২’ অবিলম্বে চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বৈঠকে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক নিরাপত্তা প্রস্তুতি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
আরও পড়ুন: প্রথমবার বাংলাদেশে তৈরি হবে রপ্তানীমুখী ড্রোন, জমি নিতে বেপজার সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন
তবে সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা মনে করেন, আওয়ামী লীগ চেষ্টা চালালেও নির্বাচন বনচালে সফল হতে পারবে না। তাঁর ভাষায়, দেশে বিপুল মানুষ ভোট দিতে চায়। তাই একটি পক্ষ চাইলেই বড় প্রভাব ফেলতে পারবে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম। পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে এবং নিরাপত্তা আরো জোরদার করা হবে। দেশে যাতে কোন আপত্তিকর ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে পুলিশ সর্বদা তৎপর। বিশ্লেষকরা বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর এখন বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক দলগুলো আচরণবিধি মানছে কি না, তা তদারকি করা। এ ছাড়া রয়েছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার পাহাড়সম বাধা। নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, একটা নির্বাচন কমিশন একা একা নির্বাচন করতে পারে না; তারা যত শক্তিশালী হোক, পারবে না। যদি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সহযোগিতা না করে। নির্বাচন কমিশনকে মনিটরিং করতে হবে, আচরণবিধি ভাঙলে বিধান অনুযায়ী শাস্তি প্রয়োগ করতে হবে। না হলে মাঠ সমান থাকবে না, পরিবেশটা অন্যরকম হয়ে যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, আমরা জানি আমাদের পুলিশ অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে এখনও সেনাবাহিনী দেশে আছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলার সে রকম উন্নতি আমরা দেখি না।
এবারের নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে মনে করেন অনেকে। কেননা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোট এবারের নির্বাচনের নতুন অনুসঙ্গ। এর সাথে পরিচিত নন সাধারণ ভোটররা। তাই বিভ্রান্তির আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করেন দিলারা চৌধুরী। তিনি বলনে, নির্বাচনে দুটি ব্যালট এবং দুটি বুথ করার কথা বলা হয়েছিল। এখানে ভোটাররা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গণভোট কিন্তু সাধারণত হয়, গণভোটের ব্যাপক প্রচার থাকতে হয় এবং একটিই প্রশ্ন থাকে যে- আপনার এটিতে সম্মত কি না? সুযোগ আছে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার। না হলে পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে ভোটিং ব্যবস্থাকে অপব্যবহার করে ক্ষমতাদখলের। নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, একটা নির্বাচন না। আগামী ২০-৩০ বছরের নির্বাচনের জন্য আমাদের এমন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যাতে নির্বাচনি পদ্ধতিকে ব্যবহার করে কেউ কোনোদিন ক্ষমতায় না আসতে পারে। অর্থাৎ এখানে নির্বাচনকে ধারাবাহিকভাবে সুষ্ঠু করতে হবে। এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন ১২ কোটি ৭৬ লাখের বেশি ভোটার, যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ।





