অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় প্রতিমা মুন্ডার অর্থের অভাবে নিভে যাচ্ছে প্রতিভা

Sanchoy Biswas
সৈয়দ আব্দুস সালাম পান্না, সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ৫:০৮ অপরাহ্ন, ২৪ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৫:৪২ পূর্বাহ্ন, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

সাতক্ষীরা তালা উপজেলার খলিশখালী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের প্রতিমা মুন্ডার সবচেয়ে প্রিয় খেলা ফুটবল। মাঠে বল পায়ে ছুটে চলা, দেশের জন্য গোল করা—এটাই তার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন টিকে আছে এক সুতোয়।

অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় প্রতিমা মুন্ডা আজ দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে মাঠে দেশের গৌরব বয়ে আনা এই কিশোরীর প্রতিভা, অন্যদিকে মাটির ঘরহীন জীবন আর টানাপোড়েনের সংসার। প্রশ্ন এখন একটাই—অর্থের অভাবে কি প্রতিমার প্রতিভা থেমে যাবে?

আরও পড়ুন: কাপাসিয়ায় তাওহিদী জনতার উদ্যোগে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ

প্রতিমার জন্ম খুলনার কয়রায়। ২০০৯ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ তাদের বসতভিটা কেড়ে নেয়। জীবনের নিরাপত্তার খোঁজে পরিবারটি চলে আসে সাতক্ষীরায়। বাবা শ্রীকান্ত মুন্ডা ইটভাটায় শ্রমিক হিসেবে বছরজুড়ে কাজ করেন, আর মা সুনিতা মুন্ডা অন্যের মৎস্যঘেরে শ্রম দিয়ে সংসার চালান। তিনবেলা খাবারের নিশ্চয়তা নেই, তবু মেয়ের পড়াশোনা ও খেলাধুলা বন্ধ হতে দেননি।

গাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই প্রতিমা ফুটবলে অনন্য ছিল। স্কুল, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে একের পর এক জয় এনে দেয় সে। তখনই তার প্রতিভা চোখে পড়ে স্থানীয় প্রশিক্ষক আরিফুল হাসান প্রিন্সের। আরিফুল হাসান তাকে নিজের সন্তানের মতো করে গড়ে তোলেন—খেলাধুলা ও শৃঙ্খলার পাঠ দেন।

আরও পড়ুন: কুলাউড়ায় বিশেষ অভিযানে ১৪ জন গ্রেপ্তার

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জেলা পর্যায়ে সুনাম অর্জনের পর প্রতিমা জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পান। স্টেডিয়ামে নিয়মিত অনুশীলন, প্রভাতে মাঠে দৌড় আর রাতে আলো-নেভা বাতির পাশে পড়াশোনা—এই ছিল তার জীবন। ২০২১ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়। তারপর ভালো খেলে বয়সভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ (২০২১) এবং এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ (২০২৩) খেলায় অংশগ্রহণ করে। সুনান কাপ অনূর্ধ্ব-১৭ (২০২৩) সালেও খেলেছিল।

প্রতিমা জাতীয় দলের হয়ে ভারত, মিয়ানমার ও পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে দেশের জন্য গৌরব অর্জন করেছে। জাতীয় দলে তিনি খেলেন ডিফেন্ডার হিসেবে। তার সতীর্থরা বলেন, প্রতিমা মাঠে যেমন দৃঢ়, তেমনি বাইরে বিনয়ী ও পরিশ্রমী।

বর্তমানে প্রতিমা ঢাকায় একটি কলেজে এইচএসসি পড়ছেন এবং বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বেতন প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও, অভাবের তাড়নায় প্রতিমা পাঁচ বছরের মাসিক ফি বিকেএসপিকে দিতে পারেননি। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ভিয়েতনামে খেলার কারণে এক বছরের খরচ মওকুফ করা হয়। তারপরও বিকেএসপি এখনো তার কাছে ৪৬,৮৪০ টাকা পাবে।

এদিকে বিকেএসপির অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মোহাম্মদ ইমরান হাসান, স্মারক নং ২০২৫/৬১২, গত ২৫ সেপ্টেম্বর বকেয়া বেতন পরিশোধের জন্য প্রতিমা মুন্ডা (প্রশিক্ষণার্থী নং: ফু-৯৩৩)-এর ২০২৫ সালের দ্বিতীয় কিস্তিসহ (জুন ২০২৫ পর্যন্ত) বকেয়া বেতন সর্বমোট ৪৬,৮৪০ টাকা পরিশোধের চিঠি দেন। উক্ত চিঠিতে তিনি আরও উল্লেখ করেন—বেতন নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করলে প্রশিক্ষণার্থী সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২১ এর অধ্যায়-৩ এর ৪ নং ধারার অনুচ্ছেদ (গ)(viii) মোতাবেক ‘চূড়ান্ত সতর্কীকরণ’ এবং অনুচ্ছেদ (ছ)(vi) মোতাবেক তিন কিস্তি বা ১২ মাসের বেশি বকেয়া থাকলে বহিষ্কারের বিধান রয়েছে।

চিঠি পাওয়ার পর থেকে প্রতিমা মুন্ডা ও তার পরিবার হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ এই অঙ্ক তাদের মতো শ্রমজীবী পরিবারের পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব।

মা সুনিতা মুন্ডা দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকাকে বলেন, “মেয়ের খরচ জোগাতে অন্যের ঘেরে কাজ করি। ভগবান যেন মেয়েকে আশীর্বাদ দেন, দেশ যেন তার গর্ব হয়—এই প্রার্থনাই করি।”

তিনি আরও বলেন, একটি স্থানীয় সংস্থা সহানুভূতির বশে তাদের জন্য একটি ছোট ঘর তৈরি করে দিয়েছে, কিন্তু ঘরে যাওয়ার রাস্তা পর্যন্ত ঠিকমতো নেই। সরকারি সাহায্য মেলেনি বহুদিন।

প্রতিবেশী বিবেকানন্দ, সুনীল রায়, শেফালী মুন্ডা, তুলসী মুন্ডারা বলেন, প্রতিমা আমাদের গ্রামের গর্ব। যদি সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা একটু সহায়তা করেন, এই মেয়েটি একদিন দেশকে বড় কিছু উপহার দিতে পারবে।

তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপা রানী সরকার বলেন, এই মুহূর্তে সরকারি কোনো বরাদ্দ না থাকলেও সুযোগ এলে প্রতিমার জন্য বসতঘর ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে।

দারিদ্র্য যেন প্রতিমা মুন্ডার প্রতিভার শত্রু না হয়—এই প্রত্যাশা সবার। মাঠে দেশের পতাকা উড়ানো এক কিশোরীর স্বপ্ন যদি কেবল টাকার অভাবে নিভে যায়, তবে সেটি শুধু প্রতিমার ক্ষতি নয়, এটি পুরো জাতিরই ক্ষতি।