মন্ত্রণালয়ে তৎপর শিক্ষা সিন্ডিকেট

মাধ্যমিকের ডিজি পদে বিতর্কিত ৮ অধ্যাপকের দৌরঝাঁপ

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৭:০৩ অপরাহ্ন, ৩০ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৭:০৩ অপরাহ্ন, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রভাবশালী তিন আমলার একটি সিন্ডিকেট পুরো শিক্ষাকে জিম্মি করে রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেটটি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (ডিজি) পদে নিয়োগের জন্য আটজন কর্মকর্তার একটি তালিকা চূড়ান্ত করেছে। তবে এই আটজনের মধ্য থেকে কাকে চূড়ান্তভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি শিক্ষা উপদেষ্টা।

গত ৬ অক্টোবর প্রকাশিত ডিজি নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, আগ্রহী প্রার্থীকে সৎ, দায়িত্বপরায়ণ এবং প্রশাসনিক কাজে দক্ষ হতে হবে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণে কৃতিত্বের স্বাক্ষর থাকতে হবে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের করা এই তালিকার অধিকাংশ কর্মকর্তাই অতীতে নানা বিতর্কে জড়িত ছিলেন এবং অনেকেই বিগত সরকার আমলে বিশেষ সুবিধা পেয়েছিলেন।

আরও পড়ুন: আমরা কীভাবে কী করব, বুঝতে পারছি না: আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল

অভিযোগ অনুযায়ী, অতিরিক্ত সচিব বদরুন নাহার ও তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে এই তালিকা প্রস্তুত করা হয়। জয়পুরহাট সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব সরফরাজ তালিকার প্রথমে রয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে তিনি পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আওয়ামী সরকারের সময় একাধিক কলেজে অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ৫ আগস্টের পর ছাত্র আন্দোলনের সময় তাকে ওএসডি করা হয়, পরে জয়পুরহাট কলেজে বদলি করা হয়।

নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মোসতাক আহমেদ ভূঁইয়া প্রাক্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই। দীর্ঘদিন ধরে তিনি একই পদে বহাল আছেন। গত ৫ আগস্টের পরও প্রভাবশালী বলয়ের কারণে পদে বহাল থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি বিভিন্ন সময় শিক্ষা দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন।

আরও পড়ুন: বিএমএ ‘হল অব ফেইম’-এ নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধানের অন্তর্ভুক্তি

বরিশালের আবুল কালাম কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শামীম আহসান খানের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে সাত কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়। যদিও পরবর্তীতে তিনি প্রভাব খাটিয়ে মামলায় খালাস পান। বর্তমানে জামায়াতপন্থী একটি গ্রুপের তদবিরে ডিজি পদের দৌড়ে আছেন বলে অভিযোগ।

কবি নজরুল সরকারি কলেজের ভূগোল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সাদী মোহাম্মদ একসময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের নেতৃত্বে থেকে বিগত সরকার আমলে নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে জামায়াতঘনিষ্ঠ চক্রের সহযোগিতায় তিনি ডিজি পদের জন্য লবিং করছেন।

সরকারি তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ ড. ছদরুদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের প্রমাণ পাওয়ায় একাধিকবার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে নারী সম্পর্কিত অসদাচরণ, কলেজ ফান্ড তছরুপ ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এসব সত্ত্বেও প্রভাবশালী মহলের তদবিরে তিনি বর্তমান পদে বহাল আছেন এবং ডিজি পদের মৌখিক পরীক্ষাও দিয়েছেন।

বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মেহেরুন নেছার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী সরকারের সময় বিভিন্ন বিদেশি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, কিন্তু সেসব বিষয়ে দেশে কখনো পাঠদান করেননি। পারিবারিকভাবে জামায়াতঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা ও তার স্বামী দুজনেই শিক্ষা ও কৃষি ক্যাডারে কর্মরত। তিনিও বর্তমানে ডিজি পদের প্রতিযোগিতায় রয়েছেন বলে জানা গেছে।

ঢাবি ছাত্রলীগের সাবেক নেত্রী এবং শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক রায়হানা তসলিমা তালিকায় রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং তার স্বামীও শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক পদে থেকে প্রভাব বিস্তার করতেন। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

তবে শিক্ষা ক্যাডারের ১৪ ও ১৬ ব্যাচের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিজ্ঞপ্তিতে সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের কথা বলা হলেও তালিকায় এসেছে সবচেয়ে বিতর্কিত নামগুলো। শিক্ষা প্রশাসনকে আবারও অস্থির করার ষড়যন্ত্র চলছে। তারা বলেন, যদি এই তালিকার বিতর্কিতদের মধ্য থেকে কাউকে ডিজি করা হয়, তবে প্রশাসনে নতুন করে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।

একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্তব্য করেন, ৫ আগস্টের পর নতুন প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এখন সেই জায়গায় ফ্যাসিবাদী আমলের বিতর্কিতদের ফিরিয়ে আনা হলে তা হবে শিক্ষাক্ষেত্রে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরারকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল দিলেও তার মোবাইলটি বন্ধ পাওয়া যায়।