প্রযুক্তি কারও চাকরি কাড়ে না; কাড়ে সেই ব্যক্তি, যে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আপনাকে পেছনে ফেলে দেয়

Any Akter
পারভেজ আহমেদ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তা
প্রকাশিত: ১:১৩ অপরাহ্ন, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৯:৪৬ পূর্বাহ্ন, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

প্রযুক্তি: সুযোগ না সংকট?

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতি নিয়ে প্রায়শই আমরা দ্বিধায় ভুগি। অনেকেই মনে করেন, প্রযুক্তি আমাদের কর্মসংস্থানের জন্য এক বিশাল হুমকি। কিন্তু এই ধারণাটি কি সত্যি? নাকি প্রযুক্তি নিজেই আমাদের জন্য খুলে দিচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার?

আরও পড়ুন: শুরু হয়েছে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ, দেখুন 'ব্লাডমুন'-এর বিরল দৃশ্য

আসুন, বাস্তবতাকে একটু অন্যভাবে দেখি। প্রযুক্তি কোনো ব্যক্তির চাকরি সরাসরি কেড়ে নেয় না। বরং সেই ব্যক্তিই কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েন, যিনি প্রযুক্তির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হন। সহজভাবে বলতে গেলে, যদি আপনি একটি নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারেন, তবে আপনার চেয়ে দ্রুতগতিতে কাজ করা অন্য একজন সহজেই আপনার জায়গা দখল করে নেবে।

বদলে যান, না হলে আপনাকে বদলে দেবে

আরও পড়ুন: আজ পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ, বাংলাদেশ থেকেও দেখা যাবে

একটু ভাবুন, একসময় হিসাবরক্ষণের জন্য শুধু খাতা-কলম ব্যবহার করা হতো। এখন একটি আধুনিক সফটওয়্যারই সেই কাজটি আরও দ্রুত ও নিখুঁতভাবে করে দিচ্ছে। এর মানে কি হাজার হাজার হিসাবরক্ষকের চাকরি চলে গেছে? না। বরং যারা এই নতুন সফটওয়্যার ব্যবহার করা শিখেছেন, তারা নিজেদের দক্ষতা বাড়িয়ে আরও বেশি সুযোগ তৈরি করেছেন। অন্যদিকে, যারা পুরোনো পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে আছেন, তারা ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।

এটি শুধু হিসাবরক্ষকের ক্ষেত্রেই নয়, সব পেশার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একজন শিক্ষক যখন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আরও বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাতে পারেন, তখন তিনি প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকেন। একজন সাংবাদিক যখন ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে আরও কার্যকর সংবাদ তৈরি করেন, তখন তার কাজের মান আরও বেড়ে যায়।

ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি

প্রযুক্তিকে ভয় পাওয়ার পরিবর্তে এটিকে আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করুন। আপনার পেশার সাথে সম্পর্কিত নতুন প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে জানুন এবং সেগুলো শিখতে সময় দিন। মনে রাখবেন, আজকের বাজারে টিকে থাকার জন্য শুধু দক্ষতা যথেষ্ট নয়, সেই দক্ষতাকে প্রযুক্তির মাধ্যমে আরও শাণিত করা জরুরি।

প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আপনি আপনার কাজের গতি বাড়াতে পারেন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে পারেন এবং নিজের পেশাগত মানকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। তাই, প্রযুক্তিকে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং আপনার সহযোগী ভাবুন। কারণ, এই প্রতিযোগিতার যুগে হয় আপনি প্রযুক্তির সাথে চলবেন, নয়তো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য কেউ আপনাকে ছাড়িয়ে যাবে।

প্রযুক্তি বনাম মানুষ: এক অসম প্রতিযোগিতা?

প্রযুক্তিকে প্রায়ই একটি অসম প্রতিযোগিতার কারণ হিসেবে দেখানো হয়, যেখানে মানুষের পরাজয় অনিবার্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তি নিজেই মানুষের বুদ্ধিমত্তার একটি অনন্য সৃষ্টি। এটি মানুষের কাজকে সহজ করতে, সময় বাঁচাতে এবং নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, যখন কৃষি ক্ষেত্রে ট্রাক্টর আবিষ্কৃত হলো, তখন এটি হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ কমিয়ে দিল। কিন্তু একই সময়ে ট্রাক্টর পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং এর যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হলো।

একইভাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা রোবটিক্স যখন কোনো একটি কাজ মানুষের চেয়ে ভালো করতে পারে, তখন আমাদের উচিত সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আরও জটিল বা সৃজনশীল কাজে মনোযোগ দেওয়া। প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে স্মার্ট হোম ডিভাইস—সবকিছুই আমাদের জীবনকে সহজ করেছে। তেমনি কর্মক্ষেত্রেও প্রযুক্তি আমাদের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে পারে।

পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ

এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানসিকতা। পুরোনো অভ্যাস এবং পদ্ধতির প্রতি আমাদের যে আসক্তি, তা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নতুন কিছু শেখার আগ্রহ। সব বয়সের মানুষের জন্যই শেখার সুযোগ সবসময় খোলা থাকে। অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে বা বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে সহজেই নতুন দক্ষতা অর্জন করা যায়। অনলাইন কোর্সের পাশাপাশি ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মও এখন নতুন দক্ষতা অর্জনের এক বিশাল উৎস। বিভিন্ন শিক্ষামূলক ভিডিও এবং টিউটোরিয়ালের মাধ্যমে আপনি যেকোনো বিষয় সম্পর্কে সহজেই জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।

ভবিষ্যতের কর্মবাজার এমন একটি জায়গায় চলে যাচ্ছে, যেখানে শুধু ডিগ্রি বা অভিজ্ঞতা দিয়ে টিকে থাকা কঠিন। বরং যিনি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন, তিনিই সফল হবেন। এটি এখন আর কোনো বিকল্প নয়, বরং টিকে থাকার জন্য একটি অপরিহার্য কৌশল।

শেষ কথা

প্রযুক্তি মানবজাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক চালিকাশক্তি। এটি কর্মসংস্থান কেড়ে নেয় না, বরং নতুন ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি করে। এটি সেই ব্যক্তির জন্য হুমকি, যিনি শেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর সেই ব্যক্তির জন্য সুযোগ, যিনি প্রযুক্তিকে তার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যান।

তাই, প্রযুক্তিকে ভয় পাবেন না, বরং এটিকে আলিঙ্গন করুন। মনে রাখবেন, আপনার চাকরি প্রযুক্তির কারণে যাবে না, বরং সেই ব্যক্তির কারণে যাবে, যে আপনার চেয়ে দ্রুত প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।

লেখক: পারভেজ আহমেদ, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও উদ্যোক্তা