চুয়াডাঙ্গায় বৈধ ও অবৈধ রেলগেটের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা

তরতাজা যুবক ছিলেন জীবন আলী (২৫)। নিমিষেই ট্রেনে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান আমিরপুর গ্রামের যুবক। এতটাই নির্মম ভাবে মৃত্যু হয় যা কল্পনাতীত। চুয়াডাঙ্গা থেকে একটি ট্রেন পোড়াদহ অভিমুখে যখন ছেড়ে যাচ্ছিল তখন তিনি অরক্ষিত রেলগেটের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু একই সময়ে আরও একটি আন্তঃনগর রুপসা এক্সপ্রেস ট্রেন আলমডাঙ্গা থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে আসছিল। এই ট্রেনটি সেই যুবক খেয়াল না করেই রেললাইনের উপর উঠে পড়েন। তারপর ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ট্রেনের ইঞ্জিনে জড়িয়ে জীবন আলীর মরদেহ প্রায় ১০০ মিটার দুরে চলে যায়। আর তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুরে টেংরামারি গ্রামে টেনে নিয়ে যায়। মরদেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এ ঘটনার পর স্থানীয় মানুষ আন্তঃনগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনটি আটকে অবরোধ করেন। এখানে স্থায়ীভাবে রেলগেট ও গেটম্যানের দাবি তোলেন। এভাবে গত সাত মাসে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে কাটা পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: ভোলায় শুল্ক ফাঁকি দেওয়া অবৈধ সিগারেটসহ আটক ৩
অনুমোদনহীন অরক্ষিত রেলগেট, ত্রুটিযুক্ত ব্যারিয়ার, গেটম্যানের স্বল্পতাসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে ঝুঁকিপুর্ণভাবে চলছে চুয়াডাঙ্গার রেলক্রাসিংগুলো। ঘটছে হতাহতের মত ঘটনা। অবৈধ রেলগেটগুলোতে দায়সারাভাবে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গেট ও গেটম্যান না থাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে চলাচল করা পথচারী, ছোট-বড় যানবাহন, বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর অবাধ বিচরণ রয়েছে। এ সব এলাকার বৈধ ও অবৈধ গেট এলাকায় চলাচলকারীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেন পথচারী ও দোকানিরা। ট্রেন আসার সময় হলেই তারা নিরাপত্তার স্বার্থে গেটের কাছে এসে সাবধানে যাতায়াতের জন্য নির্দেশনা দেন। স্থানীয়রা বারবার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তাগাদা দিলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। অনেকেই বলছেন অসচেতনতার কারণে ঘটছে হতাহতের মত ঘটনা। নিরাপত্তার স্বার্থে রেললাইনের উপর দিয়ে দেখেশুনে চলাচল করতে হবে।
আরও পড়ুন: ভারতীয় চোরাচালান ধরতে গিয়ে নৌকা ডুবে বিজিবি সদস্য নিখোঁজ
১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে রেলপথে প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেই থেকে ট্রেন চলাচল রয়েছে। বর্তমানে রেলপথ দিয়ে আন্তঃনগর, মেইল ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ট্রেনে যাওয়া আসা ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় মানুষ অনেকটা নির্ভরশীল হয়েছে ট্রেনে করে যাতায়াতে। চুয়াডাঙ্গায় ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সাত মাসে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৯ জন। জেলায় রেলপথ রয়েছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আমিরপুর গ্রামের মানুষ রেললাইনের উপর দিয়ে চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করেছে। সেখান দিয়ে শিক্ষার্থী, পথচারীসহ ছোট-বড় যানবহনগুলো নিয়মিত চলাচল করে। ২০২৫ সালের ৮ জুলাই আমিরপুর রেলগেটে ট্রেনে কাটা পড়ে একই গ্রামের জীবন আলী নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৫ জুলাই রাতে মুন্সিগঞ্জ বেদবাড়ী এলাকার রেলগেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এখান দিয়ে যাতায়াতের সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবি রেলগেট স্থাপন করে গেটম্যান দেওয়া হোক।
রেলওয়ের তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৩০টি বৈধ গেট রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি গেটে গেটম্যান নেই। যার কারণে বৈধ গুলো মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। ৫টি অবৈধ গেট রয়েছে। রেলপথের উপর দিয়ে চলাচলের জন্য মানব সৃষ্ট আরও ২৫টি রাস্তা রয়েছে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর, মেইল ও পণ্যবাহী ট্রেন দিন-রাতে চলাচল করছে চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে। গেটের কাছে থাকা দোকানি ও সাধারণ মানুষ গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ট্রেন আসা-যাওয়ার সময়।
স্থানীয়রা জানান, চুয়াডাঙ্গা আমিরপুর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে। রেললাইনের উপর দিয়ে সহজে যাওয়ার জন্য মানুষ চলাচল করেন। যেখানে মানুষের চলাচল বেশি সেখানে রেলগেট নির্মাণ ও গেটম্যান প্রয়োজন। তাহলে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে।
চুয়াডাঙ্গা জিআরপি ফাঁড়ির ইনচার্জ জগদীশ চন্দ্র বসু বলেন, গত সাত মাসে চুয়াডাঙ্গায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে ৯ জন। পুলিশ প্রতিটি ঘটনার আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। সর্বশেষ আমিরপুর গ্রামে অবৈধ রেলগেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। যা ছিল মর্মান্তিক ঘটনা। এখানে রেলগেট হওয়া প্রয়োজন।
চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, বৈধ রেলগেট রয়েছে চুয়াডাঙ্গা অংশে ৩০টি। যার মধ্য ১৫টি গেটে কোনো গেটম্যান নেই। বৈধ গেটগুলো যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ সেখানে অবৈধ স্থানে কিভাবে নিরাপত্তা দেব আমরা। মানুষ সহজে পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য রেললাইনের উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। বৈধ গেটে লোকবল সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। গেটম্যান পেলেই সমাধান সম্ভব। রেলের হিসাব অনুযায়ী ৫টি অবৈধ গেট রয়েছে। এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।