ইতালি যাওয়ার আশায় দালালের খপ্পরে নিঃস্ব মাদারীপুরের বহু পরিবার

Sadek Ali
রকিবুজ্জামান, কালকিনি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ২:৩৯ অপরাহ্ন, ০১ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ৮:৩৯ পূর্বাহ্ন, ০১ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের বাসিন্দা রাকিব মহাজন (২৩)। ইচ্ছা ছিল স্বপ্নের দেশ ইতালি যাবে। এজন্য অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য যোগাযোগ করেন দালালদের সঙ্গে। ইতালি পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে তাদের কথায় আস্থা রাখেন রাকিব মহাজন ও তার পরিবার।তবে রাকিবের কপালে বোধহয় অন্য কিছুই লেখা ছিল.!

দালালচক্রের ফাঁদে পড়েন তিনি। দফায় দফায় রাকিবের পরিবারের কাছ থেকে মোট ৪৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় দালালচক্র।কিন্তু এত টাকা দিয়েও প্রাণে বাঁচতে পারেননি রাকিব। দীর্ঘ তিন বছর গেমঘরে বন্দি থেকে লিবিয়ায় দালালদের নির্যাতনে মারা যান রাকিব।

আরও পড়ুন: ইতিহাসের সবচেয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে: প্রেস সচিব

নিহত রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন বলেন, ‘দফায় দফায় টাকা দিয়ে আমি সর্বস্বান্ত। আমার ছেলেকে না খাইয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে দালালরা। টাকা দিয়েও ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না.! আমি দালালদের বিচার চাই।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রাকিব মহাজন নয়, ইতালি যেতে গিয়ে দালালদের ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন মাদারীপুরের অসংখ্য যুবক। নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। নির্যাতনের পাশাপাশি অনেকের ঠাঁই হয়েছে লিবিয়ায় কারাগারে।

আরও পড়ুন: ঢাকা ইস্ট-ওয়েস্ট এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প বাতিলের দাবিতে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে মানববন্ধন

এদিকে পুলিশ বলছে,’বেশিরভাগ ক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের কোনো লিখিত কাগজপত্র না থাকায় পার পেয়ে যাচ্ছে দালালরা।এরফলে আইনের আশ্রয় চাইলেও বেশিরভাগ দালালই ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এ কারণেই মাদারীপুরে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে লিবিয়া দিয়ে ইতালি পাঠানো দালালরা।’

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৩০ বছর ধরে মাদারীপুরের বহু যুবক অবৈধভাবে লিবিয়া হয়ে ইতালি গেছেন।আবার এদের ভিতরে যাওয়ার পথে সমুদ্রে প্রাণ গেছে অনেক যুবকের। অনেককে বরণ করতে হয়েছে লিবিয়ায় বন্দিজীবন। এতে নিঃস্ব হয়েছে শত শত পরিবার। তবুও মাদারীপুর থেকে ইতালি যাওয়ার এ প্রবণতা কমছে না.! কিছু যুবক এ পথে কম খরচে ইতালি পৌঁছে যাওয়ায় দিন দিন এ পথ বেছে নেয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আর এতে দালালরা হচ্ছে লাভবান।

ভুক্তভোগী ও একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ইতালি যাওয়ার জন্য প্রথমদিকে দালালদের ব্যবহার থাকে খুবই মধুর। এরপর তারা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা নিয়ে চুক্তি করেন। ভালো সম্পর্ক আর সর্বোচ্চ বিশ্বাসের ফুলঝুরি দিয়ে ১২-১৫ লাখ টাকার মধ্যে চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী টাকা পাওয়ার পর কয়েকটি দেশ ঘুরিয়ে লিবিয়ায় আনা হয়। লিবিয়ায় আনার পর দালালদের শুরু হয় নানান টালবাহানা। এই দালাল চক্রের একটা পার্টি থাকে মাদারীপুরে, আরেকটি লিবিয়ায়। লিবিয়ায় থাকে মাফিয়া চক্র। মূলত এসব চক্রের মাধ্যমে চুক্তির ১২-১৫ লাখ টাকা একসময়ে দাঁড়ায় ৪০-৫০ লাখে। সেই টাকা না পেলে শুরু হয় অমানসিক নির্যাতন।আর সেই নির্যাতনের ভিডিও পাঠানো হয় পরিবারগুলোর কাছে। তখন বাধ্য হয়ে জমি-জমা, বাড়িঘর বিক্রি করে দালালদের হাতে তুলে দিতে হয় লাখ লাখ টাকা। এতে পরিবারগুলো জড়িয়ে পড়ে ঋণের জালে।

এদের মাঝে কেউ কেউ ভাগ্য ভালো হলে সমুদ্র পথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পৌঁছে যান স্বপ্নের দেশ ইতালিতে। আর তাদের দেখিয়ে দালালচক্র আবারো খুঁজতে শুরু করে নতুন পার্টি.!

মাদারীপুর জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২০২৪ সাল পর্যন্ত মাদারীপুর জেলায় মানবপাচার মামলা হয়েছে ৩১৫টি। এরমধ্যে থানায় করা মামলার সংখ্যা ১৮টি, আদালতে করা হয় ২৯৭টি। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা এক হাজার ১৩৯ জন। যার মধ্যে থানায় করা মামলায় আসামি ৯৩ জন এবং আদালতের মামলায় আসামির সংখ্যা এক হাজার ৪৬ জন।তবে গ্রেফতার হয়েছেন মাত্র ১৫৫ জন।

গত পাঁচ বছরে আদালতে ৭৮টি মানবপাচার মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। বর্তমানে আরো ১০১টি মানবপাচার মামলা তদন্তাধীন। এর বাইরে বেশকিছু মামলা প্রত্যাহারও করেছেন বাদীরা।

এ ব্যাপারে পুলিশের কর্মকর্তারা জানান,’মাদারীপুর জেলার অনেক গ্রামেই রয়েছে দালালদের বিস্তার।এদের কারণে নিঃস্ব হয়ে অনেকে থানায় অভিযোগ দিচ্ছে। তবে লেনদেনের কোন বৈধ কাগজপত্র না থাকায় এসব দালালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে।আবার এসব দালালদের বেশিরভাগ বাড়িঘরই থাকে বছরের পর বছর তালাবদ্ধ।

শুধু মাদারীপুর নয়,পার্শ্ববর্তী শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জের দালালরাও এই মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। এদেরকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’

তবে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার বিষয়ে আরো সতর্ক ও সচেতন হতে আহবান জানিয়েছে পুলিশ।