রাজনৈতিক অর্থনীতির সংস্কার, সময়ের বড় দাবি

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ মূলত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আবদ্ধ। প্রতিদিন আলোচনার কেন্দ্রে থাকে—কে সরকার গঠন করবে, কে বিরোধীতে থাকবে। অথচ এ লড়াইয়ের আড়ালে অনুপস্থিত সেই প্রশ্ন, যেটি আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে: রাজনৈতিক অর্থনীতির সংস্কার।
আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের তিন-শূন্য তত্ত্ব: বৈশ্বিক স্লোগান, জাতীয় নীরবতা
রাজনৈতিক অর্থনীতি কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশ্ন নয়; এটি হলো রাষ্ট্রের সম্পদ কিভাবে ব্যবহার হয়, কারা তার সুবিধাভোগী হয়, আর ক্ষমতার কাঠামো কীভাবে সম্পদের বণ্টনকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাজনীতি ও অর্থনীতি তাই একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো শুধুই ক্ষমতা ভাগাভাগির খেলায় ব্যস্ত—রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো সংস্কারে নয়।
আরও পড়ুন: অপরাজনীতির হাত থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য শক্ত নেতৃত্ব চাই
কেন রাজনৈতিক অর্থনীতির সংস্কার জরুরিঃ-
১. দুর্নীতি উপড়ে ফেলার জন্য – দুর্নীতি কেবল প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়; এটি আমাদের রাজনৈতিক অর্থনীতির গায়ে গেঁথে গেছে। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও স্বজনপ্রীতি দুর্নীতিকে স্থায়ী রূপ দিয়েছে।
২. ন্যায্য সম্পদ বণ্টনের জন্য – প্রকৃত অর্থনীতি তখনই কাজ করে, যখন শহর–গ্রাম, ধনী–গরিব, নারী–পুরুষ সবার মধ্যে ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টন হয়। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা বৈষম্য বাড়াচ্ছে।
৩. স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য – সংস্কার ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই জনগণের কাছে দায়বদ্ধ হতে পারবে না।
সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকঃ-
সূচক অবস্থা / পরিবর্তন সূত্র / বছর
দারিদ্র্যের হার ২০২২ সালে ১৮.৭% থেকে ২০২৫ সালে বেড়ে ২৭.৯৩% দ্য ডেইলি স্টার, ২০২৫
চরম দারিদ্র্য ২০২২ সালে ৫.৬% থেকে ২০২৫ সালে বেড়ে ৯.৩৫% দ্য ডেইলি স্টার, ২০২৫
দারিদ্র্যের ঝুঁকি অর্ধেক পরিবার ‘ঝুঁকিপূর্ণ গরিব’ শ্রেণিতে দ্য ডেইলি স্টার, ২০২৫
আয় বৈষম্য গিনি সূচক ২০১৬ সালে ০.৪৮ থেকে ২০২২ সালে ০.৫০ এইচআইইএস, ২০২২
সম্পদ বৈষম্য আয় বৈষম্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি; ধনীদের হাতে সম্পদের ঘনত্ব দ্য ডেইলি স্টার, ২০২৪
শহর–গ্রাম বৈষম্য শহরে বৈষম্য তীব্র, গ্রামে প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনা দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২০২৪
দুর্নীতি সূচক ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ২৩/১০০ স্কোর, ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫১তম ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল
পারিবারিক বোঝা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, চিকিৎসা খরচ, ঋণগ্রস্ততা, জীবনমান অবনতি —
এই সংখ্যাগুলো কী বলছেঃ-
• দারিদ্র্য ও বৈষম্য তীব্র গতিতে বাড়ছে—যা সরাসরি অন্যায্য নীতি ও সম্পদ বণ্টনের ফল।
• চরম দারিদ্র্যের পাশাপাশি তৈরি হচ্ছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ গরিব’ জনগোষ্ঠী, যারা সামান্য ধাক্কাতেই সর্বস্বান্ত।
• মোট আয় বাড়লেও সুবিধা ভোগ করছে কেবল ধনী ও মধ্যবিত্ত; নিম্নআয়ের মানুষ বঞ্চিত।
• দুর্নীতি সূচকে ভয়াবহ অবস্থান আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্বচ্ছতা প্রমাণ করছে।
বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক ও প্রেক্ষাপটঃ-
বিশ্বের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কও এই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি বৈদেশিক বাণিজ্যের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। রপ্তানির আয়ের প্রাধান্য, বাণিজ্য ঘাটতি, এবং বৈদেশিক বাজারের উপর নির্ভরশীলতা সরাসরি অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, শ্রমিকের জীবনমান, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
সাম্প্রতিক ডেটা (২০২৩–২০২৫)
বিষয় তথ্য সূত্র
মোট রপ্তানি ২০২৩–২৪: পণ্য ~US$ 44.47B, সেবা ~US$ 6.64B EPB, ২০২৩–২৪
RMG খাতের অংশ মোট রপ্তানির ~৮৫% বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২৪–২৫
মোট আমদানি ২০২৪–২৫: ~US$ 64.35B বাংলাদেশ ব্যাংক
বাণিজ্য ঘাটতি ২০২৪–২৫: ~US$ 20.39B বাংলাদেশ ব্যাংক
রপ্তানি বৈচিত্র্য RMG প্রধান, অন্যান্য খাত সীমিত: ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, আইটি BGMEA & দ্য ডেইলি স্টার
বৈদেশিক বাজার নির্ভরতা প্রধান গন্তব্য: ইউরোপ, USA, জাপান, কানাডা World Bank, WITS
চ্যালেঞ্জ ও বিশ্লেষণঃ-
• অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা RMG খাতে: বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তন অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলে।
• বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার চাপ: আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম, যা বৈদেশিক মুদ্রা সংরক্ষণে প্রভাব ফেলে।
• কর্মসংস্থান ও সুযোগের বৈষম্য: শ্রমিকরা বঞ্চিত, বড় ব্যবসায়ীরাই লাভবান।
• মূল্য সংযোজন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের ঘাটতি: উচ্চমূল্যের প্রোডাক্টে প্রবেশ সীমিত।
• বাণিজ্য নীতি ও চুক্তির প্রভাব: আন্তর্জাতিক শুল্ক, ট্যারিফ ও শ্রমিক অধিকার আইন প্রয়োগে প্রভাবিত।
সংস্কার ও করণীয়ঃ-
• রপ্তানি বৈচিত্র্য: আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, কৃষি প্রসেসিং, সবুজ শিল্প।
• শ্রমিক অধিকার ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত।
• আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বৈদেশিক বাজারে সুষম চুক্তি।
• প্রযুক্তি স্থানান্তর ও উচ্চ মূল্যের প্রোডাক্টে প্রবেশ।
জাতীয় ঐকমত্যের প্রয়োজনঃ-
শুধু সরকারের সদিচ্ছা দিয়ে সংস্কার সম্ভব নয়। সব রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে—অবিরাম ক্ষমতার লড়াই রাষ্ট্রকে দুর্বল করে এবং জনগণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই প্রয়োজন জাতীয় সংলাপ, যেখানে দলীয় স্বার্থ নয়, জনগণের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ অগ্রাধিকার পাবে।
রাজনীতির মূল হোক জনস্বার্থঃ-
রাজনীতি ঘুরে দাঁড়াবে:
• ন্যায়সঙ্গত শিক্ষা,
• সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা,
• তরুণদের কর্মসংস্থান,
• দুর্নীতি দমন,
• পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষা,
• সম্পদের ন্যায্য বণ্টন,
• সুষম ও ন্যায্য বৈদেশিক বাণিজ্যনীতি।
এসব উপেক্ষা করে কেবল ক্ষমতার লড়াই চালিয়ে যাওয়া জাতির আত্মঘাতী পথ।
উপসংহারঃ-
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে—পরিবর্তন আসে তখনই, যখন জনগণ উঠে দাঁড়ায়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান আবারও সেই সত্য প্রমাণ করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া কোনো আন্দোলনই স্থায়ী সাফল্য আনতে পারে না।
এখন সময় এসেছে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি পুনর্গঠনের। জনসচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, ন্যায্য বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক এবং জাতীয় ঐকমত্যই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ। বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে জনগণের প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতির সংস্কারই হবে ভবিষ্যতের চালিকাশক্তি।
লেখক: এম. এ. মতিন