মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে অপরিকল্পিত নগরায়ন
- ছুটির দিনে ভূমিকম্পে আতঙ্কিত নগরবাসী
- ঢাকার পুরোনো ভবনগুলোর ৯০ ভাগই বিল্ডিং কোড মানে না: রিজওয়ানা হাসান
- এমন ভূমিকম্প আগে কখনও অনুভব করিনি: ফারুকী
- মনে হচ্ছিল মারা যাব, বাঁচার চেষ্টায় লাফ দিয়েছি
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঁচ দশমিক সাত মাত্রার কাছাকাছি শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৮ মিনিট ২৬ সেকেন্ডে এই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে নগরবাসী। এ সময় সাধারণ মানুষকে বেরিয়ে সড়কে জড়ো হতে দেখা যায়। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে দেশ। নিকট অতীতে এমন ভীতিকর কম্পন কবে হয়েছিল, তা হয়তো ধারণার বাইরে। তবে নগরবিদরা বলছেন, বিল্ডিং কোড না মেনে অপরিকল্পিত নগরায়ন ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
কাঁপছে ঘরবাড়ি, আসবাবসহ ঝুলন্ত ফ্যান। হঠাৎ কম্পনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সাধারণ মানুষ। এ নিয়ে কথা বলেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের অনুভূতির কথা তুলে ধরেছেন উপদেষ্টা ফারুকী।
আরও পড়ুন: দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া, ‘ত্যাগ, নির্যাতন ও আপোষহীনতার অনন্য প্রতীক’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুক্রবার সকালে রিখটার স্কেলে ৫.৭ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। সিসমিক সেন্টার থেকে ১৩ কিলোমিটার পূর্বে যার অবস্থান। মাঝারি এই ভূকম্পনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। ভূমিকম্পের পর একের পর এক বের হয়ে আসে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলা কসাইটুলির ৮ তলা ভবন হেলে পড়ার খবর পাওয়া যায়। এ সময় রেলিং ধসে পড়ে নিহত হয় ৩ জন। এছাড়া তাড়াহুড়োয় বিল্ডিং থেকে নামতে গিয়ে আহত হন বেশ কয়েকজন। ঢাকা মেডিকেলে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৩৯ জনেরও বেশি।
আরও পড়ুন: বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে বন্দর চুক্তি: জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রয়োজন দূরদর্শী বাস্তবতা
আরমানিটোলার একজন বলেন, “আমার মুখে কোনো ভাষা নেই। আমার হাত-পা কাঁপছে। শুনলাম এখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। পরে আমি আমার বাসা থেকে চলে আসলাম।”
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবী ফারজানা ন্যান্সি বলেন, “হঠাৎ করে সব কাঁপাকাপি শুরু হয় আর মনে হয় যেন ঝমঝম শব্দে কিছু ভেঙে পড়ছে।” এ সময় তার অফিসের একটি কক্ষের ফলস সিলিং খুলে পড়ে বলেও জানান তিনি। সাত তলা ভবনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসার পর একজন সহকর্মীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেন বলে জানান ন্যান্সি।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা জেসমিন আক্তার বলেন, “আমি রান্নাঘরে ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মেঝে দুলছে। প্রথমে বুঝিনি। যখন দেখি জিনিসপত্র পড়ে যাচ্ছে, তখন দৌড়ে নিচে নামি। ২০ বছরের জীবনে এমন কাঁপন দেখিনি।”
একটি পুরাতন ভবনের পাঁচতলায় থাকেন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসক ইমরান হোসেন। যখন ভূমিকম্প হচ্ছিল তখন ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ কাঁপুনিতে ঘুম ভেঙে যায় এবং খালি পায়ে দৌড়ে নিচে নেমে যান তিনি।
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মেহেরুন নাহার মেঘলা লিখেছেন, “এইটা মোটেও ৫.২ এর মতো না! আমার ইহজীবনে এমন প্রাকৃতিক দুলুনি অনুভব করিনাই! পুরা পাক্কা ঘুমটা ভেঙে গেছে! পায়ের নিচে মেইনরোডের পিচঢালা রাস্তা এপাশ-ওপাশ দুলতে থাকল!”
সাব্বির রহমান লিখেছেন, “ভূমিকম্প এত শক্তিশালীভাবে এর আগে টের পাইনি কখনো।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল আলম চৌধুরী লিখেছেন, “এমন কম্পন জীবদ্দশায় কখনও অনুভব করিনি।”
মনে হচ্ছিল মারা যাব, বাঁচার চেষ্টায় লাফ দিয়েছি:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভবন ধসের আশঙ্কায় জানালা দিয়ে লাফিয়ে বা হুড়োহুড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে অন্তত এক ডজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
আহতদের মধ্যে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী তানজির হোসেনের অবস্থা গুরুতর। তিনি জানান—“বিছানায় বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ ফ্যান অস্বাভাবিকভাবে ঘুরছিল, মনে হচ্ছিল ছাদটা এখনই মাথার ওপর ভেঙে পড়বে। মনে হচ্ছিল মারা যেতে পারি। তাই লাফ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।”
লাফ দিয়ে তার পা ভেঙে যায়। বর্তমানে তিনি চিকিৎসাধীন।
তার মতো আরও চারজন—সাদিক শিকদার, ফারহান তানভীর রাজীব, তানভীর আহমেদ ও আরেকজন—লাফ দিয়ে আহত হয়েছেন।
জিয়া হলের আরাফাত জানান—“হলের পলেস্তারা খসে পড়ছিল। কোনো কিছু ভাবার সময় ছিল না। সিঁড়িতে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছিল, পড়ে যাই।”
ভূমিকম্পে ঢাবির বেশ কয়েকটি হলের পুরোনো ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, মুহসীন হলের স্থায়িত্বের মেয়াদ ২০১০ সালে শেষ হয়ে গেছে, তবুও তারা ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন।
নগরবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “ভূমিকম্প হলে কয়েক ঘণ্টা বা এক দিন পরেও আফটারশকে আরেকটি ভূমিকম্প আসতে পারে। তুরস্কে আফটারশকেই ভবন পড়ে যেতে দেখা গেছে। হেলে পড়া বা ফেঁটে যাওয়া ভবন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।”
পুরোনো ভবনগুলোর ৯০ ভাগই বিল্ডিং কোড মানে না: পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন—“ঢাকার পুরোনো ভবনের প্রায় ৯০ শতাংশই বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত। এসব ভবনে প্রকৌশলগত সমাধান জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “বারবার ভূমিকম্প আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে। এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার সময়।”
সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লেখেন—“এমন ভূমিকম্প আগে কখনও অনুভব করিনি! হয়তো এটাই শেষ দিন হতে পারতো। সবকিছু কতটা ভঙ্গুর, তা মনে করিয়ে দেয়!”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় কম্পন এটি। মাটির ওপর কম্পনের তীব্রতা অত্যন্ত বেশি।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১২৫ বছরে দেশে শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হয়নি। আজকের ভূমিকম্পটিকে ‘শ্যালো কম্পন’ বলা হচ্ছে, যা বড় ভূমিকম্প হওয়ার আগে একটি স্ট্রেস রিলিজ।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৫.৭। আর মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, এর তীব্রতা ছিল ৫.৫।





