ভূমিকম্পের উদ্ধার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে লুটের আয়োজন

Sanchoy Biswas
বাংলাবাজার রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৩:৫৩ অপরাহ্ন, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ | আপডেট: ৮:২৪ পূর্বাহ্ন, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

  • প্যাসিফিকেশন প্রণয়ন কমিটির সদস্যরা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী
  • বিদেশি একটি কোম্পানিকে কাজ দিতে দেয়া হয়েছে অপ্রয়োজনীয় শর্ত
কতিপয় অপ্রয়োজনীয় শর্ত জুড়ে দিয়ে নিজস্ব লোককে কাজ পাইয়ে ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার সরঞ্জাম ক্রয় প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের লুটপাটের আয়োজন প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। সম্প্রতি ডাকা দরপত্রে এমন কিছু অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় শর্তজুড়ে দেওয়া হয়েছে; যাতে বিদেশি একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান ওই দরপত্রে অংশ নিতে পারবে।

আরও পড়ুন: নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের 'গোপন বৈঠকে' অংশ: মেজর সাদিকুলের স্ত্রীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পতিত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রভাশালী একটি মহল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে অন্যদের সুযোগ দিচ্ছে না। এতে যন্ত্রপাতি সংগ্রহে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের ঘোষণাপত্র দেওয়ার বৈধতা নেই: ফরহাদ মজহার

যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সংশ্লিষ্টরা জানান, ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতি রোধে এবং উদ্ধার ও অনুসন্ধান কাজের লক্ষ্যে বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসসহ বিশেষায়িত কয়েকটি সংস্থার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। বিষয়টি নজরে এনে ২০০৮ সালে মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে তৎকালীন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো যন্ত্রপাতি ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রকল্পের মাধ্যমে ২০০৭ সাল থেকে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি বাংলাদেশ আমর্ড ফোর্সেস ডিভিশন, সিটি কর্পোরেশনসমূহ এবং ফায়ার সার্ভিসকে দেওয়া হয়। এতে তাদের সক্ষমতা অনেকটা বৃদ্ধি পায়। সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এই একই প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে প্রকিউরমেন্ট অব ইকুইপমেন্ট ফর সার্চ, রেসকিউ, অপারেশন অ্যান্ড এনার্জি কমিউনিকেশন ফর আর্থকোয়াক অ্যান্ড আর্দার্স ডিজাস্টার প্রজেক্ট (পেজ-৩) এর মাধ্যমে কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি প্রকল্পের আহ্বান করা দরপত্রের বিপরীতে ই-পিজি পদ্ধতিতে প্রাক দরপত্র সভায় সম্ভাব্য দরদাতের মতামত আহ্বান করা হয়। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ই-জিপি পদ্ধতিতে প্রাক দরপত্র সভায় অধিকাংশ দরদাতারা প্রকল্পের ক্রয় কার্যক্রমের স্পেসিফিকেশন প্রণয়ন নিয়ে আপত্তি তোলে। স্পেসিফিকেশন সংশোধন ও পরিমার্জনের অনলাইনে লিখিত প্রস্তাব চাওয়া হয়। কয়েকজন দরদাতার সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দেওয়া স্পেসিফিকেশন অসৎ উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়ার লক্ষ্যে সাজানো হয়েছে। স্পেসিফিকেশন প্রণয়ন কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিগত পতিত সরকারের সুবিধাভোগী। যারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের লক্ষ্যে সকল যন্ত্রপাতি নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা আরও বলেন, ‘ভূমিকম্পের রেসকিউ সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে জাপানের কবুলকো, হিটাচি, কমারসো, আমেরিকার জন্ডেরি, তুরস্কের হাইড্রোম্যাক, সুইজারল্যান্ডের রিভারালসহ কোনো বিশ্ববিখ্যাত কোনো কোম্পানিকে দরপত্র আহ্বানের সুযোগ রাখেনি। শুধু মাত্র ক্যাটার ফিলার নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রে অংশগ্রহণের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে এটি স্বীকৃত যে, স্বনামধন্য যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী বা প্রস্তুতকারীগণ তার নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রস্তুতকৃত গাড়ী, যন্ত্রপাতি, কন্সট্রাকশন ইক্যুইপমেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিন আন্তর্জাতিক মানে উৎপন্ন করে এআইএসও সার্টিফিকেট গ্রহণ করে। যার একটি ম্যানুফ্যাকচারিং স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস অনুযায়ী হয়। উল্লিখিত দরপত্রের স্পেসিফিকেশন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সেখানে সুনির্দিষ্ট একটি আইএসও নম্বর রয়েছে শুধু বিশ্বে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্যই প্রযোজ্য। এতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আহ্বানকৃত দরপত্রে এক্সভেটর, ব্যাকহো লোডার, মটর গ্রাডার, ক্রেস, ফর্ক লিফট, ডাম্প ট্রাক,  বুলডোজার ইত্যাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সকল যন্ত্রপাতি সংগ্রহের কাজ ওই একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। উল্লেখিত সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতিসমূহের যে পরিমাপ দেওয়া হয়েছে তাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন অধিকাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বকীয়তা বজায় রেখে উৎপাদনকৃত এক্সভেটর, ব্যাকহো লোডার, মটর গ্রাডার, ক্রেস, ফর্ক লিফট, ডাম্প ট্রাক,  বুলডোজার স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সরঞ্জামাদি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হবে। ইঞ্জিন স্ট্যান্ডার্ড, ক্যাবের উচ্চতা, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বাকেট, ব্লেড, ওয়ার্কিং রেঞ্জ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এমন করে স্পেসিফিকেশন দেওয়া হয়েছে যে, কয়েক মিলিমিটারের জন্য অধিকাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশগ্রহণে বঞ্চিত হবে। কারন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগন তাদের নিজ নিজ স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে যন্ত্রপাতি উৎপাদন করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে কয়েক মিলিমিটার হেরফেরের জন্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা কার্যক্রম ব্যহত হবে। এসব স্পেসিফিকেশন পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও প্রতিযোগিতা আইনেরও পরিপন্থি। 

এবিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান  বলেন, ‘বিষয়টি প্রকল্প পরিচালক দেখাশোনা করেন। যেসব স্পেফিকেশন থাকে সেগুলো আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন, ফায়ার সার্ভিস যা অন্য যে সংস্থা আছে তাদের সঙ্গে মিলে তাদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। আমরা এককভাবে এসব স্পেসিফিকেশন তৈরি করি না। এবিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বিস্তারিত বলতে পারবেন।’

এবিষয়ে প্রকল্প পরিচালক (যুগ্মসচিব) কাজী শফিকুল আলম বলেন, ‘বিশ্বখ্যাত অনেক প্রতিষ্ঠান এই দরপত্রে অংশ নিবে। যারা অংশ নিতে পারবে না তারা হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে অপপ্রচার করতে পারে। যথাযথ নিয়মে দরপত্র ডাকা হয়েছে এবং বিশ্বখ্যাত কোম্পানীগুলোর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।’