বাধ্যবাধকতা থাকলেও মাদকের প্রতিনিধি নিচ্ছে না
অনুমোদিত বারে র্যাবের অভিযান নিয়ে গুরুতর অভিযোগ

রাজধানী ঢাকার সরকার অনুমোদিত বার ও রেস্টুরেন্টগুলোতে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাবের বিতর্কিত অভিযান নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিনিধি বা অনুমতি ছাড়া দেশের অনুমোদিত বারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এককভাবে অভিযান পরিচালনার আইনগত বৈধতা না থাকলেও র্যাবের কতিপয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হচ্ছে। অনুমোদিত বারের বৈধ কাগজপত্র সঠিক থাকলেও মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা আদায়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন অজুহাতে ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযানের নামে লুটপাট করা হচ্ছে বলে বার মালিক সমিতি অভিযোগ করছেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর ২০ থকে ২৩ ধারা পর্যন্ত বারে অভিযানের বিষয়ে বলা রয়েছে। আইনের ২০ ধারায় বারে প্রবেশ ও ইত্যাদি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালককে। এই ধারায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত বারে মহাপরিচালক বা তার নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রবেশ, জব্দ ও তল্লাশি করতে পারবে। তবে অন্য কোনো বাহিনীর কথা বলা নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বারের অনুমোদন বা লাইসেন্স মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর দেয়, তারাই এর দেখভাল করেন। বারে কোনো সংস্থা বা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই মহাপরিচালকের অনুমোদন নিতে হবে এবং তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে রাখতে হবে।
অভিযোগে জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও র্যাবে পুরোনো কিছু কর্মকর্তা এখনও বহাল আছে। লীগ সরকারের সময়ে তারা নানা অজুহাতে বিভিন্ন বারে অভিযানের নামে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত অন্যথায় মামালা দিত।
আরও পড়ুন: বাধ্যতামূলক অবসরে ডিএমপির সাবেক ৯ ওসি
বার মালিকরা জানায়, সংস্থাটির কিছু সদস্য ও সোর্স কয়েকটি বারে বিনামূল্যে অ্যালকোহল সেবন, পারসেল নেওয়ার পাশাপাশি মাসোহারা দাবি করে আসছেন। ওই মাসোহারা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর কয়েকটি বারে অভিযান চালানোর হুমকি দেয়। বিষয়টি বার মালিকরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উটেছে গত বুধবার র্যাব-১ কোম্পানি কমান্ডার মেজর আহনাফের নেতৃত্বে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত রাজধানীর উত্তরা আবদুল্লাহপুরে টাইগার এন্টারটেইনমেন্ট নামে একটি বারে অভিযানকে ঘিরে। অভিযানের শুরুতেই র্যাব সদস্যরা বারের সিসি ক্যামেরা বিকল করে এবং ফুটেজ খুলে নেয়।
আরও পড়ুন: হাসিনার প্রিজম দিয়ে বাংলাদেশকে দেখায় ভারতকে মূল্য দিতে হচ্ছে
বার কর্তৃপক্ষ জানায়, র্যাব সদস্যরা ১২ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা, চারটি ল্যাপটপ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাতটি মোবাইল ফোন, অফিসিয়াল ফাইল (লাইসেন্স, আমদানি, উত্তোলন সংক্রান্ত ও সংশ্লিষ্ট সব কাগজপত্র), ক্রাউন ভেবারেজ থেকে উত্তোলনকৃত বৈধ বিয়ারের শতাধিক কেস, কেরু এ্যান্ড কোং-এর বৈধ প্রায় ৫০ কেস এবং ব্রান্ড রেজিস্ট্রেশন থাকা অ্যালকোহল জব্দ করে। এ সময় তারা বারের কর্মকর্তাদের মারপিট করে এবং ৪ জনকে আটক করে নিয়ে যায়। তবে উত্তরার টাইগারসহ অন্যান্য বারে অভিযানের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাউকে জানায়নি র্যাব। মহাপরিচালকের কোনো প্রতিনিধিও ছিলেন না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ঢাকা উত্তরা জোন) শামীম আহমেদ জানান, টাইগার বারে অভিযানের বিষয়ে অধিদফতর অবগত নয়। এছাড়া অন্যান্য বারে অভিযানের বিষয়েও তাদের জানানো হয়নি। এর আগে মহাখালীতে বেরন নামে একটি বারে অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা ও অ্যালকোহল জব্দ করে নিয়ে যায় র্যাব সদস্যরা। একই মাসে বনানী ১১নম্বর সড়কের একটি বার এবং গুলশান আরোগার ভবনের চতুর্থ তলায় একটি বারে অভিযান চালায় সংস্থাটি। ওই বার তিনটির কর্তৃপক্ষ জানায়, নগদ টাকা ও জব্দ করে নিয়ে যাওয়া কোটি কোটি টাকার অ্যালকোহলের তালিকা তাদের দেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় মাস্তান, বিভিন্ন সংস্থার চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১৮ সালে রেস্টুরেন্ট ও বার মালিকরা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিভিন্ন সংকটের কথা জানান। এরপর অধিদফতরের মহাপরিচালক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের আলোকে ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে। সেই সার্কুলারে তিনি উল্লেখ করে দেন, দেশের বারগুলোতে কারা কীভাবে অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন। এই সার্কুলার দেশের সব পুলিশ সুপার, ডিআইজি অফিস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনারের অফিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ২৭টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। সেখানেই অভিযানের বিষয় স্পষ্ট বলা হয়েছে। সেই সার্কুলার অমান্য করে ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘন করে উত্তরার টাইগার বারে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ঢাকার দুটি বারের মালিক এ প্রতিবেদককে জানান, একটি বারের অনুমোদন চাইলেই পাওয়া যায় না। এজন্য বছরের পর বছর বিভিন্ন দফতরে ঘুরতে হয়। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও সঠিক নিয়মকানুন অনুসরণের পর লাইসেন্স মিলে। কিন্তু বার দেওয়ার পর স্থানীয় মাস্তান, রাজনৈতিক ব্যক্তি, বিভিন্ন সংস্থার লোকজন অন্যায়ভাবে চাঁদা দাবি করেন। নানাভাবে হয়রানি করে। তারা আরও বলেন, বারে কী কী অ্যালকোহল রাখা যাবে, কী কী রয়েছে তা দেখভালের দায়িত্ব মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। তাদের কাছে আমরা নিয়মিত জবাবদিহি করি। তারপরও কেন অন্য সংস্থা আমাদের ডিস্টার্ব করবে। এর একটি সুরহা প্রয়োজন। আমরা তো ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে ব্যবসা করি। যাদের মদপানের অনুমতি নেই, তাদের কাছে আমরা বিক্রি করি, বিদেশি মদ রাখি, এসব অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে করা হয়, এই সমস্যা কীভাবে সমাধান করতে হবে, তা সবাই মিলে বের করতে হবে। তাই বলে কেউ অন্যায়ভাবে চাঁদা দাবি করতে পারেন না। এই চাঁদা না দিলেই অভিযানের নামে কোটি কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। উত্তরার ওই বারে অভিযান পরিচালনার পর মেজর আহনাফ সাংবাদিকদের জানান, দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স ছাড়াই বারের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও বিদেশি মদ আমদানিতে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো কাগজ ছিল না। অপরদিকে টাইগার রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারের ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম দাবি করেছেন, তাদের বৈধ বার লাইসেন্স রয়েছে। যার লাইসেন্স নম্বও ০১/২০২১/২০২২। অভিযান পরিচালনার সময় র্যাব সদস্যরা বারের লাইসেন্স দেখতে চায়নি। তারা কোনো কথা শুনতে চাননি। এমনকি বারে বৈধ ও অবৈধ এই দুই ধরনের মদ ও বিয়ারও শনক্তা করেনি। তারা ঢালাওভাবে সব মদ ও বিয়ার জব্দ করে। এছাড়া অভিযান চালানোর সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তাও সঙ্গে আনেননি।
এর আগে ২০২১ সালের ১৮ মার্চ জুরাইনের আইরিস পাব অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে র্যাব ও কাস্টমস যৌথভাবে অভিযান চালায়। ওই অভিযান চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে বার মালিকপক্ষ উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা করেন। ওই মামলায় তারা দাবি করেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারা লঙ্ঘন করে তাদের বার অ্যাণ্ড রেস্টুরেন্টে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এরপর উচ্চ আদালত ওই অভিযানকে অবৈধ ঘোষণা করে নির্দেশনাও দেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২৩ ধারায় স্পষ্ট বলা রয়েছে, পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, ইত্যাদির ক্ষমতা: মহাপরিচালক অথবা তাহার নিকট থেকে এতদুদ্দেশ্যে সাধারণ অথবা বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো অফিসার, অথবা পুলিশের উপপরিদর্শক, অথবা তদূর্ধ্ব কোনো অফিসার অথবা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ল্যান্স নায়েক অথবা তদূর্ধ্ব কোনো অফিসার, অথবা কোস্ট গার্ড বাহিনীর পেটি অফিসার অথবা তদূর্ধ্ব কোনো অফিসার অভিযান পরিচালনা করতে পারবেন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, সারাদেশে ১৮৯টি রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে। এর সকল লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও মজুত দেখভাল করে এই সংস্থাটি। বাংলাদেশ বার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মেজর (অব.) জাহাঙ্গীর বলেন, র্যাব কিংবা ভিন্ন যেকোনো সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ছাড়া কোনো বৈধ কিংবা লাইসেন্সকৃত বারে এ ধরনের অভিযানে যেতে পারে না। এছাড়া এ সংক্রান্ত বিষয়ে হাইকোর্টেও একটি নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের অভিযান না করতে আমাদের সংগঠন থেকেও র্যাব মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। গত বুধবার রাতে টাইগার বারে র্যাবের অভিযান নিয়ে যতদূর জেনেছি, তাতে র্যাব এ অভিযানে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। তাদের অভিযানের পদ্ধতি সঠিক হয়নি। তাছাড়া তারা লকার পর্যন্ত ভেঙেছে। অনেক গরমিল রয়েছে। এ ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বৈঠক করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। এ ধরনের অভিযান থেকে প্রতিকার পেতে আমরা আদালতের আশ্রয় নেব।
সরকারের এলিট ফোর্স রেপিড একশন ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন বার রেস্টুরেন্টে অভিযানে মালিকদের বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে র্যাব ১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল জাহিদুল করিম বাংলাবাজার পত্রিকাকে জানান লিখিতভাবে কোন অপারেশন সম্পর্কে কোথায় অভিযোগ কি কেউ করেছেন? আইনের কোন ব্যতিক্রম থেকে থাকলে ২৪ ঘণ্টার মাঝে আমদের কাছে উপযুক্ত প্রমাণ নিয়ে আসলেই সব সমাধান হয়ে যেত। তা না করে পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে ভুল তথ্য শেয়ার করা হচ্ছে। আমি আশা করব সোশ্যাল ক্রাইম নিরসনে সকল সাংবাদিক আমাদের সাথে থাকবে। তিনি আরো জানান
র্যাব পরিচয়ে যারা বিনামূল্যে মদ খেতে যায় তাদের শনাক্ত করতে সহযোগিতা করলে খুশি হব। এর আগে এই ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের কাছে প্রমাণ ও নাম চাওয়া হয়েছিল যার ব্যাপারে উনারা সহায়তা করেনি। পরবর্তীতে আমাদের টিম একজনকে শনাক্ত করে জেলে পাঠিয়েছে।