গোপালগঞ্জে সহিংসতার উস্কানিদাতারা চিহ্নিত
গোয়েন্দা তথ্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপের মাঝে হঠাৎ করে গোপালগঞ্জে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে সর্বত্রই তোলপাড় চলছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর পূর্ব ঘোষিত গোপালগঞ্জমুখী পদযাত্রা নিয়ে শেষ মুহূর্তে দেশি-বিদেশি সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দিয়ে উত্তেজিত করার বিষয়টি চিহ্নিত করা হলেও গোয়েন্দা তথ্য ও সে মোতাবেক স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকরী ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সুলতানা রহমানের টকশোতে টুঙ্গীপাড়ায় কবরস্থান ও বাসভবন গুঁড়িয়ে দেওয়ার পদযাত্রা এবং আশপাশের জেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ এতে অংশ নেওয়ার উস্কানি দেওয়া হয়। ঢাকার ৩২ নম্বর ভাঙার অভিযানের মত এটিকে তুলে ধরা হয়। দেশে পুরাতন স্বৈরাচারসহ নেতারা এতে উদ্বিগ্ন হয়ে গোপালগঞ্জের নেতাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ করে সংগঠিত করে তোলে।
আরও পড়ুন: ড. ইউনূসের ঘোষণাপত্র দেওয়ার বৈধতা নেই: ফরহাদ মজহার
একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে গোপালগঞ্জের পুলিশকে সতর্কবার্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার নির্দেশনা দিলেও গোপালগঞ্জের পুলিশ এতে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার সকালে ভেরিফায়েড ফেসবুকে দাবি করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরামর্শ মতেই তারা গোপালগঞ্জে পথসভা করেছেন। যাত্রা শুরুর আগেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গোপালগঞ্জে সবুজ সংকেত দেয় এবং সমাবেশের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করে।
প্রশ্ন উঠেছে, গোপালগঞ্জের মত স্পর্শকাতর জেলায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের দুর্বল ভূমিকা নিয়ে। যার ফলে শেষ মুহূর্তে এনসিপির শীর্ষ নেতাদের জীবন রক্ষায় উদ্ধারে হেলিকপ্টার পর্যন্ত পাঠানোর ঝুঁকি নিতে পারেনি। দেশের সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে তাদের উদ্ধার করতে হয়েছে।
আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
গোয়েন্দা তথ্যের ব্যর্থতা ও পুলিশের ভূমিকার কথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ কর্তৃপক্ষই তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদর দপ্তর জনগণের বিরূপ আলোচনায় তাদের বক্তব্য গণমাধ্যমে তুলে ধরেছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, এরকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ কীভাবে জাতীয় নাগরিক পার্টি তথা স্বৈরাচার পতনের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান তারকাদের গোপালগঞ্জের পদযাত্রার সবুজ সংকেত দেওয়াকে ঘিরে ষড়যন্ত্র আছে কিনা।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথম দিকে গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে পুলিশের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হয়। মাঠপর্যায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিং করে সার্বিক গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রস্তুত করা হয়। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চও (এসবি) এ বিষয়ে রিপোর্ট দেয়। সব রিপোর্টে নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ঘটনার আগের দিন রাতে শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্য নিয়েও আলোচনা হয়।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিলেও জেলা পুলিশ নিরাপত্তার জন্য আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ১০০ ও আরআরএফ (রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স) থেকে ১৫০ সদস্য মোতায়েনের কথা জানানো হয় রেঞ্জ অফিসের পক্ষ থেকে। পাশাপাশি জেলা পুলিশের নিয়মিত ফোর্স দায়িত্ব পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
জেলা পুলিশ ফোর্সের পাশাপাশি অতিরিক্ত ২৫০ সদস্য দিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব বলে জানানো হয়। মাঠ পুলিশের এই চাহিদা অপূরণ হলেও কেউ গুরুত্ব দেয়নি। গোয়েন্দা তথ্য একাধিক স্থানে পদযাত্রায় হামলার বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে আগাম তথ্য দেওয়া হলেও মাঠ পুলিশের দেখা যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুইদিন ধরে টুঙ্গীপাড়ায় সমাধি কমপ্লেক্স ও আবাসিক ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ার গুজব ছড়িয়ে উস্কানি দেওয়া হলেও বিভাগীয় বা কেন্দ্রীয় পুলিশের কোন প্রতিনিধি গোপালগঞ্জে তদারকির জন্য উপস্থিত হতে দেখা যায়নি।
জেলা পুলিশের দায়সারা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাঝেই একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সংবাদ যায় গোপালগঞ্জ সদর থানাধীন মাঝিগাতি ঢালনিয়া ব্রিজের গোড়ায় ১০০/১৫০ জন লোক জড়ো হয়ে আছে। একই সাথে গোপালগঞ্জ সদর থানাধীন কাজুলিয়া ও কাটি ইউনিয়নে ৭০০/৮০০ জন লোক কাটি ইউনিয়নের খেলনা ব্রিজের নিচে জড়ো হয়ে আছে।
গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী উপজেলার মাঝিগাতি স্ট্যান্ডে লোকজন জড়ো হয়ে আছে। বেলা সাড়ে আটটার দিকে এরকম গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জেলা পুলিশ চারজন পুলিশ সদস্যের একটি দল পাঠায় সেখানে। পুলিশ দেখা মাত্রই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা হামলা করে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুলিশ দৌড়ে পালিয়ে যায়।
তারপর থেকে গোপালগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে শহরের দিকে আসতে থাকে। এভাবেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
গোপালগঞ্জের ঘটনার পর এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে, সকালের নাশকতার পরও সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পেয়েই আমরা গোপালগঞ্জে প্রবেশ করেছি। পদযাত্রা করি নাই, পথসভা করেছি শুধু। গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে আমাদের লোকজনকে আসতে দেওয়া হয় নাই। বিভিন্ন জায়গায় বাস আটকে দেওয়া হয়েছে। এরপরও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পথসভা শেষ করেছি। যাওয়ার পথে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে আমরা সেভাবে সেখান থেকে বের হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা চারজনের মৃত্যুর কথা শুনেছি। কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না, প্রত্যাশা করি না। সন্ত্রাসীদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থা যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নিতো তাহলে এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এ দায়ভার সরকার ও প্রশাসনকে নিতে হবে। আমরা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও সন্ত্রাসীদের বিচার দাবি করছি। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। শুধু গোপালগঞ্জ নয়, সারাদেশে এ গ্রেপ্তার অভিযান চালাতে হবে।
গোপালগঞ্জের এই সহিংস ঘটনায় গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দায়ী করছেন জেলা পুলিশকে। বুধবার রাতে সেনাবাহিনীর এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেলের নেতৃত্বে এক সমন্বয় সভায় পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান নিজেই ভুলের কথা স্বীকার করেছেন। প্রশ্ন হল, মাঠ পর্যায়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এই পুলিশ কর্মকর্তাকে কীভাবে গোপালগঞ্জের মত জেলায় পুলিশ সুপার পদে পদায়ন করা হলো। চাকরি জীবনে তার মাঠ পর্যায়ে অভিজ্ঞতা নেই। পুলিশের আইজিপি বাহারুল আলম বাংলাবাজার পত্রিকাকে জানান, গোপালগঞ্জের সহিংসতার বিষয়টিকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সচিব পর্যায়ের একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। ওই কমিটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা আমাদের তথ্য-উপাত্ত, ভূমিকা তাদের কাছে তুলে ধরব। ভবিষ্যতের জন্য আমরা এতে অবশ্যই শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। তিনি জানান, ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজিকে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক গোপালগঞ্জ থেকে বাংলাবাজার পত্রিকাকে জানান, জাতীয় নাগরিক পার্টির পদযাত্রাকে ঘিরে জেলা পুলিশের চাহিদা মোতাবেক আমরা সকল প্রয়োজনের ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু এরপরেও ঘটনাটি ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। হয়তো জেলা পুলিশের কার্যক্রমে কিছু ভুল থাকতে পারে, তা আমরা দেখছি। হামলাকারীদের উস্কানিদাতা, অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে তাদের গ্রেপ্তারের অভিযান চলছে।