আটক মেজর সাদেক এর বিরুদ্ধে তদন্ত আদালত গঠন

সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়া ৪ শতাধিক গেরিলা কোথায়?

Sanchoy Biswas
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৮:০০ অপরাহ্ন, ০১ অগাস্ট ২০২৫ | আপডেট: ২:৪২ অপরাহ্ন, ০২ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও সভায় হামলা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরা গুপ্তা হামলা করে একে অস্থিরশীল করে তুলতেই নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-যুবলীগের বাছাই করা তরুণদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। সামরিক বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের দিয়ে এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক গেরিলা সর্বহারার আদলে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গোয়েন্দা তথ্য ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে এক সেনা কর্মকর্তা সহ ২২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্ন হল, প্রশিক্ষণ নেওয়া এই গেরিলারা কোথায় আছে? তাদের গ্রেপ্তার না করলে সারাদেশে নাশকতার আশঙ্কা থেকে যায়।

এদিকে আন্তঃবাহিনীর গণসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সম্প্রতি একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক জনৈক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সংক্রান্ত অভিযোগ পাওয়া যায়। অভিযোগটি প্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে, গত ১৭ জুলাই ২০২৫ তারিখে উক্ত সেনা কর্মকর্তাকে তার নিজ বাসস্থান রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে আটক করে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: আয়কর রিটার্নে ‘জিরো রিটার্ন’ নামে কোনো ব্যবস্থা নেই: এনবিআর

ঘটনাটির সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে এবং প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পূর্ণ তদন্ত সমাপ্তি সাপেক্ষে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে উক্ত সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করা হচ্ছে।

এছাড়াও, তার কর্মস্থল থেকে অনুপস্থিত থাকা সংক্রান্ত ব্যত্যয়ের বিষয়ে অপর আরেকটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে এবং তদন্ত শেষে আদালতের সুপারিশক্রমে সেনা আইন অনুযায়ী দায় নিরূপণ (Command Responsibility) করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আরও পড়ুন: ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে সংগ্রহ করা হচ্ছে ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং পেশাদার প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কোনো সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনো সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার সকল সদস্যের মধ্যে পেশাদারিত্ব, শৃঙ্খলা ও সাংবিধানিক দায়িত্ববোধ বজায় রাখার প্রতি সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায় রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ বৈঠকের রহস্য উদ্‌ঘাটনে এবং পেছনে জড়িতদের বের করতে ‘গুরুত্ব দিয়ে’ তদন্ত করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৮ আগস্ট ঘিরে নানা হুমকি নিয়ে আলোচনার বিষয়ে পুলিশ বলছে, আগস্ট কেন্দ্রিক কোনো ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা নেই।

গত ৮ জুলাই বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন একটি কনভেনশন সেন্টারে ‘গোপন বৈঠকের’ ঘটনায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ২২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ বৈঠকে মেজর সাদিকুল হক নামের এক সেনা কর্মকর্তার অংশ নেওয়ার অভিযোগ উঠলে তাকে হেফাজতে নেয় সেনাবাহিনী। ওই বৈঠক ও গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।

শুক্রবার (১ আগস্ট) বিকেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে এসব বলেন তিনি।

মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, গত ৮ জুলাই বসুন্ধরা এলাকায় কে.বি. কনভেনশন হলে একটা বৈঠক নিয়ে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। কনভেনশন হলটি শামীমা নাসরিন শম্পা নামে একজন ব্যক্তি ভাড়া নেন। সে সময় তিনি বিদেশে লোক পাঠানোর নাম করে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে লোকজনকে নেওয়া হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ জুলাই ভাটারা থানায় একটি মামলা করা হয়।

তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে ইতোমধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখছি। এ ঘটনার অন্য কোনো দিক আছে কি না, এর প্রকৃত রহস্য কী এবং কারা কারা এর পেছনে দায়ী? ঘটনার সঙ্গে কারা কারা জড়িত শিগগিরই উন্মোচন করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন পুলিশের এ কর্মকর্তা।

বৈঠক ও ৮ আগস্টের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা হুমকির আলোচনা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তালেবুর রহমান বলেন, আমরা গত একটা বছরে বিভিন্ন সময় দেখেছি নানা সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কার্যক্রম অনেকেই করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সজাগ রয়েছি।

গত এক বছরে ঢাকা মহানগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমানে আগস্ট কেন্দ্রিক কোনো রকমের নিরাপত্তা শঙ্কা দেখছি না। আমরা সবসময় সতর্ক রয়েছি। আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সক্ষমতা রয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য কিছু লোক বিভিন্ন অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান ডিএমপির এ কর্মকর্তা। এর পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখা ও এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ সংগঠনের আটজনকে গ্রেপ্তারের তথ্য দেন।

তালেবুর রহমান বলেন, আমাদের কাছে যে গোয়েন্দা তথ্য আছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে কারো বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল ইসলাম খান জানান, বসুন্ধরা কনভেনশনে প্রশিক্ষণে যোগ দেওয়া ২২ জনকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের তৎপরতা চালানো হচ্ছে। তারা যাতে কোনো প্রকার নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য পুলিশ তৎপর রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২ জুলাই বসুন্ধরা কে বি কনভেনশন সেন্টার ভাড়া নিয়ে ৮ জুলাই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেন। সশস্ত্র গেরিলা প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর ভাটারা থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে।

মামলায় বলা হয়েছে, ৮ জুলাই ভাটারার একটি কনভেনশন সেন্টারে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ গোপন বৈঠকের আয়োজন করে। ওইদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও অবসরপ্রাপ্ত অংশ নেন। ওই মামলায় এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা এখন কারাগারে আছেন। ডিবি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন। ‘তারা প্রিয় স্বদেশ’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘প্রজন্ম ৭১’, ‘শেখ হাসিনা’সহ বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য। একটি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে জানতে পেরেছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ওই গোপন সভার আয়োজন করা হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১২ জুলাই উত্তরা পশ্চিম থানার একটি বাসা থেকে যুবলীগ নেতা সোহেল রানাকে গ্রেপ্তার করে ভাটারা থানা পুলিশ। ওই দিন একই এলাকার একটি বাসা থেকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর স্বামী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। দুজনকে গ্রেপ্তারের পর ১৩ জুলাই ভাটারা থানার সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা হয়। সূত্র জানায়, সোহেল রানা ও শম্পাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য যাচাই করা হয়। তাঁদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিককে হেফাজতে নেওয়া হয়।

ডিবি সূত্র বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা এবং গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন শম্পা বলেছেন, মেজর সাদিকের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তৃণমূল আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংগঠিত করে বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ভাটারা এলাকার কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয় তলা ভাড়া নেওয়া হয়। মেজর সাদিক সেদিন সরকার উৎখাতে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। এর আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আরও অন্তত চারটি প্রশিক্ষণ হয়েছিল। তবে সব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভিডিও ফুটেজ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। পুলিশ বলছে, গোপন এ ষড়যন্ত্রে যারা জড়িত ছিলেন, সবাইকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।