ODB প্রধান সমন্বয়ক কে এইচ সুশান্ত দাস গুপ্ত
গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে সুমাইয়া জাফরিনের দায় স্বীকার করে ভয়ংকর তথ্য

গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে আটক সুমাইয়া জাফরিন দায় স্বীকার করে বলেছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের গেরিলা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে কে.পি.আই. (কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) প্রতিষ্ঠানে হামলাসহ ঢাকা ব্লকের পরিকল্পনা করেছিল। মেজর সাদিক জাফরিন প্রতিটি প্রশিক্ষণেই অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। তবে সকল প্রশিক্ষণ সমন্বয় করত সুশান্ত দাস গুপ্ত নামে একজন।
জাফরিনকে জিজ্ঞাসাবাদে সারাদেশে নাশকতার ভয়ংকর তথ্য দিয়েছে। জাফরিন ODB (অপারেশন ঢাকা ব্লক)-তে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। ODB-র কিছু সদস্যদের সে রেজিস্ট্রেশন করেছে, তবে সবার করেনি। তার স্বামী মেজর সাদেকুলের ODB-র সাথে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে, তবে সাদেকুল সমন্বয়ক তা অস্বীকার করে। সে বলে "সুশান্ত দাস গুপ্ত" সবকিছু সমন্বয় করে এবং সবরকম নির্দেশনা দেয়।
আরও পড়ুন: ৮ উপদেষ্টার দুর্নীতির কথিত অভিযোগ দেয়ার পর সাত্তারের ফোন বন্ধ, বিএনপির অস্বীকার
KB কনভিকশন হল, মিরপুর ডিওএইচএস, কাঁটাবন মোড়, সি সেল রিসোর্ট—তারা স্বামী-স্ত্রী উপস্থিত ছিল তা স্বীকার করে, তবে তারা ২০/২৫ মিনিট ছিল। ওইসব মিটিংয়ে তাদের কার্যক্রমের কথা অস্বীকার করে।
পূর্বে গ্রেফতারকৃত সোহেল রানা জবানবন্দিতে বলে, মেজর এবং তার স্ত্রী সমন্বয়ক ছিল। সোহেলের সাথে পরিচয় এবং তাদের বাসায় সোহেলের যাওয়া-আসা আছে, তা স্বীকার করে। সুশান্ত দাসের সাথে তার কথা হতো, মেজরের কথা অস্বীকার করে। ODB-র সাজ্জাদুল আনাম, শিমুল, সোহেল রানা, ইয়ামেন—সাথে তার কথা হয়, তার বাসায়ও যায়।
আরও পড়ুন: চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে আহত ও অসুস্থদের চিকিৎসা সহায়তা দিলেন তারেক রহমান
সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথা অস্বীকার করে। ট্রেনিং সেন্টারের কথা অস্বীকার করে। মেজরের হার্টের সমস্যার কারণে অসুস্থ অবস্থায় সিক লিভ নিয়ে ঢাকায় আসে এবং লিভ এক্সটেনশন করতে থাকে।
জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নেওয়া একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মেজর সাদিক, তার স্ত্রী সুমাইয়া এবং অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট গুলশান আরার কেসটাকে আমরা যতটা সহজ হিসেবে নিয়েছি, আদতে এটা অতটাও সহজ নয়। যথেষ্ট কমপ্লিকেটেড। তাদের পরিকল্পনার ব্যাপারে আমরা যতটুকু জেনেছি, আসল পরিকল্পনা তার চেয়েও ডেঞ্জারাস এবং ইফেক্টিভ।
আওয়ামী লীগের কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে মেজর সাদেকের নাম, পরিচয়, কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে তাকে তো ঠিকই অ্যারেস্ট করা হয়, কিন্তু তার ওয়াইফ সুমাইয়াকে অ্যারেস্ট করার প্ল্যান কিন্তু ছিল না।
সুমাইয়াকে যেদিন অ্যারেস্ট করা হয়, সেদিন কক্সবাজারে ১০ম পদাতিক ডিভিশন বা রামু ক্যান্টনমেন্টের একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ আর্মির তিন থেকে চারজন মেজর সাদেকের স্ত্রী সুমাইয়ার সাথে একটি রেস্টুরেন্টে সাক্ষাৎ করেন। তাদের মাঝে কথাবার্তা চলাকালীন সময়েই ডিসি-ডিবি (ডিভিশনাল ক্রাইম ডিটেকটিভ ব্যুরো) তার টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। ডিসি-ডিবি উপস্থিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে বলেন: “স্যার, উনাকে (সুমাইয়া) আমাদের কাছে দিতে হবে, আমাদের হাতে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে"; কিন্তু তিনি সুমাইয়াকে হ্যান্ডওভার করতে না চেয়ে বরং বলেন “তার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে”।
পরবর্তীতে ডিসি-ডিবি জোরাজুরি করলে তিনি আর্মি হেডকোয়ার্টার ডিপিএসকে (ডিরেক্টর পার্সোনাল সার্ভিসেস) কল করেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বাছবিচার না করে সুমাইয়াকে ডিবির হাতে হ্যান্ডওভার করার জন্য এক্সেস দেন।
সাদিক-সুমাইয়া-গুলশান আরার কেসটি বর্তমানে হ্যান্ডেল করছে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল/টিম। অর্থাৎ ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি, ডিবি—সমন্বয় করে কাজ করছে। এর আগে বহুদিন যাবত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল শুধুমাত্র ডিজিএফআইয়ের কন্ট্রোলে ছিল (ক্ষেত্রবিশেষে র্যাবেরও)।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাদেক-সুমাইয়ারা যাদের ট্রেনিং করিয়েছেন, এরা মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদেরকে যে ট্রেনিংটা দেওয়া হয়েছে, এর নাম “সাব-ট্যাকটিকাল আরবান ওয়ারফেয়ার”। এটাকে আমরা অনেকে সহজভাবে গেরিলা ট্রেনিং বলেও জানি।
তাদের প্ল্যান ছিল ঢাকা শহরের কেপিআই বা “কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন” গুলিকে টার্গেট করা; বিশেষভাবে—‘এম্বাসি’। এছাড়া কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটাল, সিএমএইচ, পপুলার হসপিটাল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি।
এধরনের হাই ভ্যালু টার্গেটের আফটার ইফেক্ট হয় অত্যন্ত মারাত্মক, আর সেসব দিক বিবেচনা করেই তারা এসব ইনফ্রাস্ট্রাকচারগুলিকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর পরিকল্পনা করেছিল।
তাদের মূল লক্ষ্য ছিল চলতি বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের মাঝে দেশে অ্যানার্কি বা ক্যাওস তৈরি করা। কয়েকটি এম্বাসিকে লক্ষ্যবস্তু বানানো গেলে আন্তর্জাতিকভাবেই বাংলাদেশ কোনঠাসা হয়ে পড়ত।
পতিত ফ্যাসিস্ট রেজিমের মন্ত্রী-এমপি সহ রেজিম কর্তৃক বিভিন্নভাবে বেনিফিসিয়ারি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনগুলোর যে তদন্ত চলমান— সে কাজগুলি বাধাগ্রস্ত হতো এবং এটাকে লেন্থি বা পুরোপুরি বন্ধ করার উদ্দেশ্যেই উক্ত পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
একইসাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দিরে হামলার পরিকল্পনাও ছিল তাদের।
পরিকল্পনা সফল হলে বাংলাদেশ এমনিতেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থন হারাত, আর ঠিক সেটারই অ্যাডভান্টেজ নিয়ে ফায়দা লুটত ভারত। সংখ্যালঘু নির্যাতনের কার্ডকে পুনরায় জাগ্রত করে বিভিন্ন কনসালটেন্সি এবং লবিং ফার্মকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করিয়ে ইন্টারিম সরকারকে রিজাইন করানো'ও ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশবিশেষ।
শুধু তাই নয়, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারত তাদের এয়ার অ্যাসেটস দ্বারা বাংলাদেশ সীমান্তে ২ থেকে ৩ দিনের লিমিটেড স্ট্রাইক করবে—এই তথ্যও নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এই প্ল্যান একদম সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য, প্রাইমারি লেভেলে দেশের অভ্যন্তরে ক্যাওস তৈরি করাটাই ছিল তাদের লক্ষ্য।
তবে যেহেতু উক্ত র্যাকেটের অন্যতম দুই মাস্টারমাইন্ড এখন বন্দি, একইসাথে ট্রেইনিংপ্রাপ্ত ৪০ জনের অধিক গ্রেফতার হয়েছে, তাই উক্ত পরিকল্পনা আপাতত ভেস্তে গেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার ওসিকে বঙ্গবন্ধু গেরিলা বাহিনী প্রধান পরিচয়ে ফোন করে হুমকি দেওয়ার পরেই আলোচনায় আছে গেরিলা বাহিনী। গত জুলাই বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে উচ্চস্বরে স্লোগানের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জানা যায় কর্মী সমাবেশের কথা। পরে আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, সেখানে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল সারা দেশ থেকে আসা বাছাই করা আওয়ামী লীগ কর্মীদের।
আটক শম্পা ও সোহেল রানার জবানবন্দিতে আসে মেজর সাদিকুল হক, তার স্ত্রী ইউএন লাইব্রেরি কর্মকর্তা সুমাইয়া জাফরিন ও অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট গুলশান আরার কথা। মেজর সাদিককে সেনা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার স্ত্রী সুমাইয়াকে ডিবি আটক করে টাস্ক ফোর্স গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে লেফটেন্যান্ট গুলশান আরা ও মূল মাস্টারমাইন্ড সুশান্ত দাস গুপ্তের কথা।