হঠাৎ দাবি আদায়ে উত্তপ্ত রাজপথ নেপথ্যে কী?

Any Akter
মোস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব
প্রকাশিত: ১:৩২ অপরাহ্ন, ১৪ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ৪:২০ অপরাহ্ন, ১৪ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

জাতীয় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ও নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে হঠাৎ করেই বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলনকারীরা রাজপথে অস্থিতিশীলতা তৈরীর চেষ্টা করছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘিরে আন্দোলনকারীরা একের পর এক মারমুখী কর্মসূচি দিচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে কেন এই বিশৃঙ্খলা তৈরীর কর্মসূচি, কারা ইন্ধন দিচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যই বা কি রাজনৈতিক মহলে সেটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এক বছর পর জাতীয় পার্টির হঠাৎ সমাবেশ আবার সেখানে কঠোর পুলিশি এ্যাকশনের ফলে রাজপথ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গত দুইদিন ধরে শিক্ষক আন্দোলন ও কঠোর পুলিশি অ্যাকশন আগে লক্ষ্য করা যায়নি। এরই মধ্যে বিভাগ, জেলা, উপজেলা তৈরি নিয়ে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে চলছে আন্দোলন। যমুনা সেতু বন্ধ করে দিয়েছে আন্দোলনকারীরা। 

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকারের সময়ে নানা দাবিতে প্রায় প্রতিদিন আন্দোলন চলে। প্রতিদিন গড়ে ৪টি আন্দোলন হচ্ছে রাজধানীতে। এর মধ্যে ফ্যাসিস্ট শক্তিও নানাভাবে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। আনসার বিদ্রোহ, পুলিশ ও প্রশাসনের লোকদের মাধ্যমে ছোট-বড় কমপক্ষে প্রায় পনের'শ আন্দোলন হয়েছে গত এক বছরে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক বছরে রাজধানীতে এক হাজার ৫৯৮ আন্দোলনের মধ্যে চাকরি-সংক্রান্ত ৫৯১টি করেছে ৪৬টি সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের লোকজন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে চাকরি জাতীয়করণ, পুনর্বহাল, বেতন বৃদ্ধি, গ্রেড পরিবর্তন ও বকেয়া পরিশোধ। এর মধ্যে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আলাদা ১০ প্রতিষ্ঠানের লোকজন ১৮৯টি আন্দোলন করে। বকেয়া বেতন- ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজধানীতে ৭০টি আন্দোলন করেছে ৯টি তৈরি পোশাকশিল্প কারখানার শ্রমিকরা।

আরও পড়ুন: বিকাল ৪টার মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি না করলে ‘মার্চ টু সচিবালয়’

এবার হঠাৎ করেই আন্দোলনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজধানী। একযোগে ঢাকার কেন্দ্রস্থলে পৃথক দাবিতে তিনটি বড় কর্মসূচি চলছে। এত জনমনে দেখা দিয়েছে চাপা আতঙ্ক। সোমবার (১৩ অক্টোবর) সকাল থেকেই শহীদ মিনার, শিক্ষা ভবন ও ইস্কাটন এলাকায় আন্দোলনকারীদের জড়ো হওয়া এবং একাধিক মিছিলের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে উদ্বেগ।

এসব আন্দোলনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে, রাখা হয়েছে জলকামানসহ বিশেষ ফোর্স। তবে আন্দোলনকারীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মধ্যেও বিভিন্ন এলাকায় যান চলাচলে বিপর্যয় ও জনদুর্ভোগ বাড়তে থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা শঙ্কা বিরাজ করছে।

আরও পড়ুন: শাপলার বিকল্প বেছে না নিলে ইসির পছন্দের প্রতীক পাবে এনসিপি

ব্যস্ততম নগরী ঢাকায় একদিনে চলছে বড় তিনটি কর্মসূচি। সেগুলো হলো- তিন দফা দাবি আদায়ে দ্বিতীয় দিনের মতো শহীদ মিনারে অবস্থান করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। অন্যদিকে সাত কলেজকে একীভূত করে প্রস্তাবিত 'ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির' অধ্যাদেশ দ্রুত জারির দাবিতে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে চাকরির দাবিতে জড়ো হয়েছেন নিবন্ধনে উত্তীর্ণ চাকরিপ্রত্যাশীরা। সেখানে তারা পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান করছেন।

আন্দোলনগুলোর কারণে রাজধানীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সৃষ্টি হয়েছে তীব্র জনদুর্ভোগ।

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

রাজধানীর শিক্ষা ভবনের সামনে সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা আজ বেলা ১১টা থেকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। তাদের দাবি, সরকার ঘোষিত প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি) খসড়া অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

'সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর আন্দোলন পরিষদ'-এর ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচি পালন করছেন। সকালে পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক পৃথক স্থান থেকে পদযাত্রা করে শিক্ষা ভবনের সামনে জড়ো হন। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে নীলক্ষেত থেকে যাত্রা শুরু করে ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলিত হন। এরপর পলাশী ও বকশীবাজার হয়ে বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হন। একই সময়ে কবি নজরুল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা আসেন। তিতুমীর, মিরপুর বাংলা ও বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন পদযাত্রায়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ২০১৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতা থেকে এই কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়, যা ছিল অপরিকল্পিত। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ওই অধিভুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনো চূড়ান্ত কাঠামো কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। এ কারণে তারা এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।

অবশ্য রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ নিয়ে তারা ৬ হাজারের বেশি মতামত পেয়েছে, যা বিশ্লেষণাধীন। শিগগিরই শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ সভা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে । তবে শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, দীর্ঘসূত্রতা নয়ড়সরকারকে দ্রুত অধ্যাদেশ জারি করে এই সংকটের স্থায়ী সমাধান দিতে হবে।

শহীদ মিনারে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের অবস্থান

‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট'-এর ব্যানারে দ্বিতীয় দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীরা। আজ সকাল থেকে তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়েছেন।

তিন দফা দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন

১. মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদান ।

২.শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য মাসিক ১,৫০০ টাকা হারে চিকিৎসা ভাতা। ৩. কর্মচারীদের জন্য উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশে উন্নীত করা।

জোটের সদস্য সচিব দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেন, আমরা এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক আশ্বাস পাইনি। তবে দাবি পূরণে বিলম্ব হলে আমরা সচিবালয় অভিমুখে রওনা হবো। প্রয়োজনে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচিতে যাবো ।

এর আগে গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কর্মসূচি পালনকালে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা ও জলকামান ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেন এবং রাত সেখানেই কাটান। গতকাল সকাল থেকে আবার অবস্থান শুরু করেন তারা।

শিক্ষকরা বলছেন, আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের যে পাঠদান বিঘ্নিত হচ্ছে, তা পূরণে তারা পরে শুক্র ও শনিবার অতিরিক্ত ক্লাস নেবেন। তবে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মস্থলে ফিরবেন না।

এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে চাকরিপ্রত্যাশীদের কর্মসূচি

অন্যদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যখন দাবি নিয়ে রাজপথে তখন ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ হয়েও সুপারিশ না পাওয়া ১৬ হাজার ২১৩ জন চাকরিপ্রত্যাশী মাঠে নেমেছেন। সোমবার দুপুরে তারা অবস্থান নেন রাজধানীর ইস্কাটনের এন- টিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে।

তারা বলছেন, চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শূন্যপদ যুক্ত করে দ্রুত একটি বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি, নীতিমালা পরিবর্তনের আগে সুপারিশ বঞ্চিতদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

চাকরিপ্রত্যাশীদের দাবি, বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ করে, যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বাধার কারণে তারা নিয়োগ বঞ্চিত হয়েছেন, তা দূর করে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে হবে। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করলেও এনটিআরসিএ কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাই এবার দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছেন তারা। এক পর্যায়ে তারা সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান। রাজধানীজুড়ে আন্দোলনের প্রভাব

একই দিনে বিভিন্ন দাবিতে একাধিক কর্মসূচি চলায় রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে যান চলাচলে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। সচিবালয়, পলাশী, বকশী- বাজার, ইস্কাটন ও শহীদ মিনার এলাকা ঘিরে সকাল থেকেই তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ব্যারিকেড ও মিছিলের কারণে অফিসগামী মানুষ, শিক্ষার্থী, রোগীসহ নানান শ্রেণির মানুষকে পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে। প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়া নাগরিকদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে যানজটে।