ফরাশি রানী এন্থনির পর শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড বিশ্ব মিডিয়ায়
গণহত্যা মানবতার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইন এবং বহু দেশের অভ্যন্তরীণ আইনে এটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, যার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। ইতিহাসে অনেক স্বৈরশাসক ও রাষ্ট্রনেতা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারপ্রক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সর্বশেষ দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। এ রায়ের মাধ্যমে তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন, সার্বিয়ার স্বৈরশাসক সাবেক প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোশেভিচ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাদোভান কারাদজিক এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর জোসেফ কাবিলের সঙ্গে নাম যুক্ত করলেন।
আরও পড়ুন: ‘গোয়েন্দা টিম গঠন করেন, লোক সাপ্লাই দেব’ ওসিকে জামায়াতের প্রার্থীর মন্তব্যে বিতর্ক
এ রায়ের মাধ্যমে ২৩৩ বছর পর কোনো নারী সরকারপ্রধান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। এর আগে ফ্রান্সের সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী মারি এন্তনে ১৭৯৩ সালে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি প্রথমবারের মতো কোনো সরকারের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারবিভাগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। অপর আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে রাজসাক্ষী হিসেবে লঘুদণ্ড হিসেবে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিমের এমডি-চেয়ারম্যানসহ চারজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি মূল অভিযোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে আন্দোলন চলাকালীন সময় বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক ও পরিকল্পিত দমনপীড়ন চালানোর সরাসরি নির্দেশ দেওয়া। তার নির্দেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন—বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সশস্ত্র ক্যাডার—দক্ষিণভাবে দমনপীড়ন কার্যকর করেন। এই দমনপীড়ণের ফলে প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত ও ২৫ হাজারের বেশি মানুষ আহত, অঙ্গহানি ও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হন।
দেশে দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত সরকারপ্রধানরা
সাদ্দাম হোসেন (ইরাক)
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ২০০৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। বিচারে তার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড হয়। ৩৯ বছর (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪-এপ্রিল ২০০৩) ক্ষমতায় থাকাকালে সাদ্দাম হোসেনের নির্দেশে বহু ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল বলে প্রচলিত রয়েছে। একটি ইরাকি আদালতে ১৯৮২ সালে ১৪৮ জন শিয়া হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সাদ্দামকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ওই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কিম জং ইল (উত্তর কোরিয়া)
তিনি ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিনায়ক ও কোরিয়ান ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। তার বাবা কিম ইল-সুংয়ের মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং আমৃত্যু দেশ শাসন করেন। তার শাসনকালে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের বিপুলসংখ্যক লোককে বন্দি রাখার অভিযোগ ছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক আদালতে তার বিচার না হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উত্তর কোরিয়ায় ব্যাপক ও পদ্ধতিগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য। তার শাসনামলে হওয়া দুর্ভিক্ষ ও নিপীড়নকে অনেক বিশেষজ্ঞ গণহত্যা বা গণহত্যার সমতুল্য অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেন। ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
পল পট (কম্বোডিয়া)
খেমাররুজদের সংগঠক ও নেতা ছিলেন পল পট। তার নেতৃত্বে খেমাররুজরা ১৯৭৫ থেকে ৭৯ সাল পর্যন্ত কম্বোডিয়ার শাসন ক্ষমতায় ছিল। মাত্র চার বছরের শাসনামলে তারা কম্বোডিয়ায় যে পরিমাণ গণহত্যা চালায়, তা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম গণহত্যার একটি বলে পরিচিত। সে কারণে পল পটকে ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর, নৃশংস হত্যাকারী এক স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তার সময়ে ১৭ থেকে ২২ লাখের মতো মানুষ মারা যায়। এর প্রায় অর্ধেকই খেমাররুজ সেনাদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়। তবে পল পটের বিচার হয়নি। কারণ, ১৯৯৮ সালে গৃহবন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
স্লোবোদান মিলোশেভিচ (সার্বিয়া)
বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও কসোভোতে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ছিলেন স্লোবোদান মিলোশেভিচ। অনেকের কাছে তিনি বলকানের কসাই নামে পরিচিত। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে তার বিচার শুরু হয় কিন্তু ২০০৬ সালে কারাগারে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় মামলার রায় দেওয়া হয়নি।
ওমর আল-বশির (সুদান)
দারফুর অঞ্চলে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ছিলেন সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির। ১৯৮৯ সালে সুদানের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে একটি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত সুদানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে এর আগেই ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত দারফুরে মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং বয়স বিবেচনায় ৭৫ বছর বয়সি বশিরকে কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।
হিসেন হাব্রে (চাদ)
১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চাদে গণহত্যা, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হন দেশটির পঞ্চম প্রেসিডেন্ট হিসেন হাব্রে। তার বিরুদ্ধে ৪০ হাজারের মতো মানুষ হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সেনেগালে বিশেষ আফ্রিকান ট্রাইব্যুনালে তার বিচার হয়। ২০১৬ সালে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
রাদোভান কারাদজিক (বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা)
বসনিয়ার ভেতরে বসনিয়ান সার্বদের ঘোষিত কথিত রাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন কারাদজিক। ১৯৯৫ সালে স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যায় আট হাজারের বেশি বসনীয় মুসলমান নিহত হন। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে এজন্য তার বিচার হয়। ২০১৯ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তিনি।
জোসেফ কাবিলা
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর (ডিআরসি) সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ কাবিলা ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে একটি সামরিক আদালত তার অনুপস্থিতিতে দেশদ্রোহিতা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।
দেশে দেশে সরকারপ্রধানদের মৃত্যুদণ্ড
ইয়ন আন্তোনেস্কু
ইয়ন আন্তোনেস্কু ছিলেন রোমানিয়ার ডিফ্যাক্টো হেড অব স্টেট। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানপন্থি একটি সরকারের একনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
নিকোলাই চাউসেস্কু
রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন চাউসেস্কু। তিনি দীর্ঘ ২৪ বছর রোমানিয়াকে কঠোর কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীন রেখেছিলেন। ১৯৮৯ সালে এক বিপ্লবে উৎখাত ও নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত রোমানিয়ার নেতা ছিলেন। ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বর গণহত্যা ও অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে স্ত্রীসহ ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়।
জুলফিকার আলি ভুট্টো
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ১৯৭৭ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে পদচ্যুত ও গ্রেপ্তার হন। ১৯৭৪ সালে মার্চে বিরোধী পলিটিশিয়ান আহমেদ রাজা কাসুরির বাবা আহমেদ খান কাসুরিকে গুলি করে হত্যার অপরাধে জেনারেল জিয়াউল হকের নির্দেশে ভুট্টোর বিচার হয়। হুকুমের আসামি হিসেবে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল ফাঁসির মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ষোড়শ লুই
ফ্রান্সের রাজা ছিলেন ষোড়শ লুই। ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলেশনে গিলোটিনে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মারি এন্তনে
ফ্রেঞ্চ রেভ্যুলেশনে নিহত সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী এন্তনের অলংকার, পোশাক, জুয়া, ঘোড়দৌড় বাজি প্রভৃতিতে তার অঢেল খরচের কারণে জনগণের বিরাগভাজন ছিলেন। কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, তার জন্যই ফ্রান্স ফকির হয়ে গিয়েছিল এবং তার ফলে বিপ্লব সূচিত হয়েছিল। বিপ্লবে ষোড়শ লুইয়ের শিরশ্ছেদের পর মারি এন্তনের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড হয়।
প্রথম চার্লস
রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইংল্যান্ডে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী বিপ্লবী দলের কাছে পরাজিত হয় প্রথম চার্লসের সেনাবাহিনী। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে প্রথম চার্লসকে কুঠারাঘাতে শিরশ্ছেদের দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ১৬৪৯ সালে এ দণ্ড কার্যকর করা হয়।
অ্যান বলিন
ইংল্যান্ডের রানি অ্যান বলিন ছিলেন রাজা অষ্টম হেনরির দ্বিতীয় স্ত্রী। পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে না পারায় হেনরি তাকে ডিভোর্স দেন। হেনরি তার বিরুদ্ধে মিথ্যা পরকীয়ার অভিযোগ আনেন। ১৫৩৬ সালে কুঠারাঘাতে অ্যান বলিনের মৃত্যুদণ্ড হয়। পুত্রসন্তানের জন্ম না দিতে পারলেও অ্যান বলিনের কন্যা হয়েছিলেন ইংল্যান্ডের পরম প্রতাপশালী রানি প্রথম এলিজাবেথ।
আদনান মেন্দারেসের
ইস্তানবুল গণহত্যায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেন্দারেসকে দায়দায়িত্ব নিতে হয়। এ সুযোগে ১৯৬০ সালের ২৭ মে মেন্দারেসবিরোধী ৩৭ তরুণ আর্মি অফিসার একটি ক্যু করেন। মেন্দারেস ও তার পার্টির সব নেতা গ্রেপ্তার হন। সংবিধান লঙ্ঘন, গণহত্যা ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন তারা। ইয়াসি ইয়াদা দ্বীপে তাদের বিচার হয়। বিচারে মেন্দারেস মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ইমরালি দ্বীপে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেন্দারেসের দণ্ড কার্যকর করা হয়।
মোহাম্মদ মুরসি
২০১৪ সালে মিসরের ক্ষমতাচ্যুত, ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসিসহ ৫২৯ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় দেশটির একটি আদালত। তাদের বিরুদ্ধে সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে আনা অভিযোগে বলা হয়, তারা ছিলেন হত্যা মামলার আসামি। মুরসির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। কারণ, ২০১৯ সালের ১৭ জুন আদালতে শুনানির সময় তিনি মারা যান।





