৪০ বছর পর বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ নির্ধারণ চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সুফল: চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ এবং কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৯৯ শতাংশ পরিবাহিত হয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই অংশীদারিত্ব বলে দিচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মূল গেটওয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রার ১৩৮ বছরে নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের চাপ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণে নিজেকে তৈরি করছে প্রতিনিয়ত, হচ্ছে সমৃদ্ধ। সাথে আছে বৈশ্বিক মানদণ্ডে নিজেকে উন্নীত করার চাপ। নতুন নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হচ্ছে পরিবর্তিত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সেবা প্রদানে।
এ বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থের। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের আয়ের মূল উৎস সেবা মাশুল বা ট্যারিফ এখনো রয়ে গেছে ৪০ বছরের পুরোনো কাঠামোতে। ব্যয়ের সাথে আয়ের সামঞ্জস্য নেই। অথচ একই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য বন্দর এবং আঞ্চলিক বন্দরগুলোতে ট্যারিফ বেড়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর রুটে চলাচলকারী জাহাজের ভাড়াও বেড়েছে কয়েকগুণ।
আরও পড়ুন: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় টর্চ লাইট জ্বালিয়ে দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ, আহত অন্তত ৩০
জ্বালানি ব্যয়, জনবল ব্যয়, জাহাজ নির্মাণ ব্যয় ও অন্যান্য ব্যয় বিবেচনায় জাহাজ অপারেটররা প্রতিনিয়ত ভাড়া বাড়ালেও চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফের পরিবর্তন হয়নি ৪০ বছরেও। শুধুমাত্র জাহাজ ভাড়া নয়, বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সেবার মান বাড়ার সাথে সাথে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মাশুল।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপশি বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, যন্ত্রপাতি ক্রয় ও জ্বালানি ব্যয়, সাপোর্ট ভেসেল ক্রয়, চলাচল ও মেরামত ব্যয় বেড়েছে বহুগুণে। ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়ের বাস্তবতাকে সামনে রেখে ২০১৯ সালে সেবা মাশুল বা ট্যারিফ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয় সরকার। এর আগে ২০১৩ সালে উদ্যোগ নিলেও স্টেকহোল্ডারদের বিরোধিতায় তা আলোর মুখ দেখেনি।
আরও পড়ুন: রামগঞ্জে জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটন: স্বর্ণের লোভে মা-মেয়েকে হত্যা
২০২০ সালে সরকার আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বন্দরগুলোর ট্যারিফ বিবেচনায় বাস্তবসম্মত ট্যারিফ নির্ধারণে স্পেনের সুনামধন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডিএমকে নিয়োগ দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত ও নৌপরিবহন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে স্টেকহোল্ডারদের সাথে দীর্ঘ সময় আলোচিত ট্যারিফ চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে।
বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। ১৯৮৫-১৯৮৬ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর মাত্র ৩৯,০৫৬ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল, আর সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে এ সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৩২ লাখ টিইইউতে। সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৮১ গুণ হ্যান্ডলিং বেড়েছে। ব্যবসাবান্ধব ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নের ফলে ক্রমবর্ধমান হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হয়েছে।
হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনায় কর্তৃপক্ষকে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করতে হয়েছে শুরু থেকেই। পুরনো অবকাঠামোর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি। ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহরে টাগবোট, পাইলট বোট, অ্যাম্বুল্যান্স বোট, পানি ও জ্বালানি সরবরাহকারী ভেসেলসহ সাপোর্ট ভেসেল/বোট ছিল ১৯টি, ২০২৫ সালে এসে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ টিতে।
এ বিপুল সংখ্যাক সাপোর্ট ভেসেল ক্রয়, পরিচালন ও মেরামতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। সময়ের সাথে সাথে যুক্ত হয়েছে ডিজিটালাইজেশন ও কার্বণ নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক অঙ্গীকারের সাথে খাপ খাওয়াতে গ্রীণ পোর্টে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ।
সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩২,৯৬,০৬৭ টিইইউ, কার্গো ১৩,০৭,২৪,৭৮৩ মেট্রিক টন, জাহাজের সংখ্যা ৪,০৭৭টি। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কনটেইনার ৩১,৬৮,৬৯০ টিইইউ, কার্গো ১২,৩২,৪২,৭৪৮ মেট্রিক টন, জাহাজের সংখ্যা ৩,৯৭১টি। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কনটেইনার ৩০,০৭,৩৭৫ টিইইউ, কার্গো ১১,৮২,৯৭,৬৪৩ মেট্রিক টন, জাহাজের সংখ্যা ৪,২৫৩টি।
বেড়েছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ব্যয়: অবকাঠামোগত উন্নয়নে চট্টগ্রাম বন্দরকে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। এতে বন্দরে টার্মিনালের সংখ্যা, ইয়ার্ড স্পেস, আধুনিক যন্ত্রপাতির সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)। ২০০৭ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া এই টার্মিনাল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। যন্ত্রপাতি সংযোজনে ব্যয় হয়েছে আরও প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দরের আরেকটি আধুনিক টার্মিনাল চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)। ৪৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই টার্মিনালে ৩টি জেটি রয়েছে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছে গত বছর। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ১,২০০ কোটি টাকা।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৩ সালে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা দায়সহ এই বন্দরকে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটি নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা। মাতারবাড়ি বন্দর চ্যানেল দেশের এনার্জি সিকিউরিটি নিশ্চিত করছে। এ চ্যানেল সংরক্ষণ, জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। এজন্য সংকুলান করতে হচ্ছে বিপুল অর্থ। ট্যারিফ সমন্বয় না করলে এই ব্যয় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের অদূরেই নির্মাণ করা হচ্ছে বে টার্মিনাল। এই টার্মিনালের দুইটি টার্মিনালে বিদেশি বিনিয়োগ হবে, একটি টার্মিনাল বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করা হবে।
ঢাকার কেরাণীগঞ্জে পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৩ সালে প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই টার্মিনাল অপারেশনাল কর্মকান্ড শুরু করে। রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকামুখী পণ্যবাহী কনটেইনার পরিবহনকে আরও সহজতর করতে। এ ছাড়া কার শেড, কেমিকেল শেড, অকশন শেড, ইয়ার্ড সম্প্রসারণ, স্থাপনা নির্মাণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন ও কমিউনিটি সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হচ্ছে।
বর্তমান ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হিসেবে আগামী ৫ বছর পর আমাদের ৫ মিলিয়ন টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। ইয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে ৫৪ হাজার থেকে ৬২ হাজার। ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে হেভী লিফট জেটি। চট্টগ্রাম বন্দরের বাস্তবায়নাধীন ও পরিকল্পনাধীন সব প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন প্রায় ৩৩,৩২১ কোটি টাকা প্রয়োজন।
এ বিপুল অর্থ যোগান দিতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে বৈদেশিক বাণিজ্যে বিশেষ করে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। না পারলে আমরা পিছিয়ে যাব। যা দেশের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করবে।
এ ছাড়া, আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকাংশ সেবা এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। টার্মিনাল অপারেটিং সিস্টেম অনলাইন, পেমেন্ট, ডিজিটাল অ্যাক্সেস কন্ট্রোল, ডাটা এক্সচেঞ্জ সিস্টেম, সিটিএমএসসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সংযোজন হয়েছে। বাস্তবায়নাধীন আছে মেরিটাইম সিঙ্গেল উইন্ডো (এমএসডব্লিউ), সাইবার সিকিউরিটি ও সার্ভার সিস্টেম বাস্তবায়নের কাজ। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এআই-নির্ভর কার্গো ও ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং ও মনিটরিং প্রযুক্তি সংযোজনের। এ প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন বিপুল বিনিয়োগ।
চট্টগ্রাম বন্দর জোয়ার-ভাটা নির্ভর কর্ণফুলী নদীর তীরে অবস্থিত। কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা রক্ষায় সারাবছর ধরে সংরক্ষণ ড্রেজিং করতে হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে। চ্যানেলের থেকে মূল বন্দর এলাকার নাব্যতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা হয়েছে, যা অতি সম্প্রতি শেষ হয়েছে। এতে খালের মুখ থেকে বর্জ্য অপসারণের ফলে নগরীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমেছে। খালের মাধ্যমে কর্ণফুলীতে আসা চট্টগ্রাম নগরীর বর্জ্য ড্রেজিং কার্যক্রমকে সর্বদা বাধাগ্রস্ত করছে। বেগ পেতে হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে, উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে ড্রেজিংয়ের ব্যয়।
সাথে সাথে বেড়েছে পরিচালনগত ব্যয়। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন বিশ্বের সর্বাধুনিক কী-গ্যান্ট্রি ক্রেনের মাধ্যমে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। সাথে আছে আরটিজি, রেল-মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের আধুনিক সব যন্ত্রপাতি। এসব যন্ত্রপাতি ক্রয় যেমন ব্যয় সাপেক্ষ, তেমনি এর সংরক্ষণ ও মেরামতেও ব্যয় অনেক। ১৯৮৬ সালের পর থেকে এ খাতের ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ।
জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যয়ের খাত ও পরিবর্তনে ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ১৯৮৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১,২৫৯ শতাংশ বেড়েছে। যন্ত্রপাতি ও সাপোর্ট ভেসেলের জ্বালানি খরচ, ১৯৯৪ সাল থেকে গ্যাসের দাম বেড়েছে ১৮৪ শতাংশ, জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ১৯৬ শতাংশ, বিদ্যুৎ খরচ ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেড়েছে ৩১৮.১৫ শতাংশ। রাজস্ব ব্যয়, ১৯৮৬ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেড়েছে ৩,৫৮১ শতাংশ। ভোক্তার মূল্য সূচক বেড়েছে (কনজিউমার প্রাইজ ইনডেক্স) ১৯৮৬ সাল থেকে এ সূচকে পরিবর্তন হয়েছে ৭৩০ শতাংশ, যা বিগত ৫ বছরে প্রায় ৫.৭ শতাংশ।
অপরদিকে, আইএসপিএস কোডের নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙর সীমা মিরসরাই-সীতাকুন্ড উপকূলসহ এখন ৬২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে, যা একসময় ছিল মাত্র ১০ নটিক্যাল মাইল। এই বিশাল সমুদ্র এলাকায় চলাচলকারী জাহাজের নিরাপত্তা ও নজরদারিতে সার্বক্ষণিক কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩৫০ জন ওয়াচম্যান। সংযোজন করেছে ভিটিএমআইএসসহ আধুনিক সব প্রযুক্তি।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিবছর ক্রমবর্ধমান হারে বেতন-ভাতা, আবাসন, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সেবা নিশ্চিতে ব্যয় করতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। এ ছাড়া বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং নির্দেশনার অনুশীলন ও বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরের মতো আইএমও’র সকল স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে আইএসপিএস ও আইএমডিজির মতো আন্তর্জাতিক কোড অনুশীলন ও বাস্তবায়ন করছে। পুরো বন্দরকে সিসিটিভির মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং, ডিজিটাল অ্যাক্সেস কন্ট্রোল, ইউভিএসএস, ডাটাবেজ তৈরি, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার ইত্যাদি আইএসপিএস কোড বাস্তবায়নের অংশ। প্রতিবছর আইএমও’র প্রতিনিধিদলের পরিদর্শন ও পরিদর্শন পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে কর্তৃপক্ষ নিত্য নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করছে।
বর্তমান রয়েছে ট্যারিফ কাঠামোর দুর্বলতা: চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সরাসরি জাহাজ চলাচল আছে এমন বন্দরগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলো বৈশ্বিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিনিয়ত ট্যারিফ সমন্বয় করে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অধিকাংশ বন্দর নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে ট্যারিফ রিভিউ করে। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর একেবারে ভিন্ন। পরিচালন ব্যয় কয়েকগুণ বাড়লেও ৪০ বছরের পুরোনো কাঠামোতেই আদায় করছে ট্যারিফ।
পিছিয়ে পড়ছে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বন্দরগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায়। সেবা প্রদানের দক্ষতা ও সক্ষমতার পাশাপাশি বন্দরের আর্থিক কাঠামো প্রতিযোগিতার অন্যতম সূচক হিসেবে কাজ করে। একই সময়ে শুধুমাত্র পরিচালন ব্যয় কিংবা অবকাঠামোগত ব্যয়ই নয়, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে প্রায় ২৮৪ শতাংশ। বঙ্গোপসাগরীয় এই অঞ্চলের অন্যান্য বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ অনেক কম। যেমন, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ও টার্মিনাল প্রতি টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও সংরক্ষণ ব্যয় ১৩৪ ডলার, শ্রীলঙ্কার সাউথ এশিয়া গেটওয়ে টার্মিনাল ১৪৭ ডলার, মায়ানমারের ইয়াঙ্গুন বন্দর ১৪২ ডলার।
ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা: ১৯৮৬ সালের পরে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ রিভিউ করা হয়নি। ২০০৭ সালে বন্দরের সেবা খাতের ৫২টি সেবার মধ্যে ৫টি সেবা খাতে ট্যারিফ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। শুধুমাত্র বন্দরের ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত ও পরিচালন ব্যয় নয়, বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকতে হলে বাজার চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে ট্যারিফ রিভিউ করতে হয় প্রতিনিয়ত।
ট্যারিফ বৃদ্ধির সাথে সেবা প্রদানেও ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যায়। পার্শ্ববর্তী বন্দরগুলোর সাথে প্রতিযোগিতাপূর্ণ সেবা প্রদানে ট্যারিফ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাজার মূল্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্যারিফ বন্দর খাতে বিনিয়োগকারীদের আরও বিনিয়োগে আকৃষ্ট করে। এতে বন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি সেবার গতি বৃদ্ধি পায়।
এ ছাড়া কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নিয়ে যাওয়ার বৈশ্বিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বিশ্বের বন্দরগুলোকে এখন গ্রীণ পোর্ট ধারণার বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নিতে হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরও এর বাইরে নয়। আইএমও’র চাহিদা ও নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রীন পোর্টে রূপান্তরের বাস্তবায়ন ইতিমধ্যে শুরু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর। নতুন অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কাজে এই ধারণাকে সামনে রেখে এগোচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া বিদ্যমান অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারে কমপ্লায়েন্স শতভাগ নিশ্চিতে কাজ করছে। ফলে ট্যারিফ বৃদ্ধি নয়, সামঞ্জস্যপূর্ণ, টেকসই ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ নির্ধারণ বা সমন্বয় করার কারণ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সবসময় দেশের স্বার্থ বিবেচনায় কর্মকান্ড পরিচালনা করে।
সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্যারিফ নির্ধারণও এর অংশ। দেশের প্রধান বন্দর হিসেবে বর্হিবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয় বন্দরকে। ফলে টেকসই, বাস্তবভিত্তিক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ ট্যারিফ নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের সাথে সাথে আঞ্চলিক বন্দরগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে সেবা প্রদানের পাশাপাশি টেকসই ও বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ আবশ্যক। প্রতিযোগিতাপূর্ণ ট্যারিফ না হলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে আমাদের।
ট্যারিফ বাড়ানোর গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি: জানা যায়, চট্টগ্রাম বন্দর বৈশ্বিক সর্বাধিক ব্যবহৃত কর্মপদ্ধতির সবগুলোই অনুসরণ করেছে। বাজার বিশ্লেষণ, স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় ও সরকারের অনুমোদন—সবগুলো ধাপ ক্রমান্বয়ে অনুশীলন করে চূড়ান্ত পর্যায়ে ট্যারিফ নির্ধারণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রথমেই ট্যারিফ রিভিউ করার উদ্যোগ নেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালে স্পেনের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডমকে আন্তর্জাতিক মানের ও পার্শ্ববর্তী বন্দরগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্যারিফ নির্ধারণের দায়িত্ব দেয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বন্দরের অপারেশনাল ব্যয়, সম্পদ পুনঃস্থাপন ব্যয় ও প্রকল্প ব্যয় এবং এশিয়ার ১০টি সহ ১৭টি আন্তর্জাতিক বন্দরের ট্যারিফ পর্যালোচনা করে। এর বাইরেও দেশের মূল্যস্ফীতির হারকে পর্যালোচনায় নেওয়া হয়েছে।
ট্যারিফ প্রস্তাবের আগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বন্দরের প্রধান ১০টি স্টেকহোল্ডার অ্যাসোসিয়েশনের স্ব স্ব কার্যালয়ে গিয়ে তাদের প্রস্তাবনা ও পরামর্শ নেন। এ ছাড়া কী পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটরস (কেপিআই) এর ভেসেল ওয়েটিং টাইম, কনটেইনার ডুয়েল টাইম, স্টোরেজ টাইম, ইয়ার্ড স্পেস ম্যানেজমেন্ট, পাইলটেজ, ট্যাগ সার্ভিস, জেটি সাইট সার্ভিস, ইক্যুইপমেন্ট সার্ভিস ও বার্ষিক প্রবৃদ্ধিসহ প্রায় সবগুলো সূচক পর্যালোচনা করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য প্রযোজ্য নয় এমন সেবা খাতের ট্যারিফ।
সব যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করে ২০২২ সালে ট্যারিফ প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষ একাধিকবার ট্যারিফ চূড়ান্তকরণে মতবিনিময় করে বন্দর ব্যবহারকারী বা স্টেকহোল্ডারদের সাথে, নিয়েছে লিখিত মতামতও। সবশেষ চলতি বছরের ২ জুন ও ২৫ আগস্ট নৌপরিবহন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে আরো দুই দফা স্টেকহোল্ডারদের সাথে বৈঠক করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় চূড়ান্তভাবে অনুমোদনের আগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত ট্যারিফ থেকে আমদানি-রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী এবং সর্বশেষে সাধারণ ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ১০ শতাংশ কমিয়ে অনুমোদন দিয়েছে। এরপর ২৪ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন এবং ১৪ সেপ্টেম্বর নতুন ট্যারিফ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। এতে ট্যারিফ বৃদ্ধির প্রকৃত সুফল পাবে দেশের সাধারণ মানুষ।
সূত্র মতে, বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত সমীক্ষার (ফিজিবিলিটি স্টাডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ আঞ্চলিক অন্যান্য বন্দরের তুলনায় সর্বনিম্ন। বর্ধিত ট্যারিফ হিসাবে নিলে কনটেইনার প্রতি ট্যারিফ বৃদ্ধি পাবে ৩,৮০০ টাকা। যার প্রভাবে ভোক্তাদের ওপর প্রতি কেজি পণ্যে ব্যয় সর্বোচ্চ ১২ পয়সা বৃদ্ধি পাবে এবং প্রতি ১০০ টাকার মূল্যের পণ্যে ১৫ পয়সা বৃদ্ধি পাবে। যা ভোক্তাদের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। এদিকে দেশের রপ্তানিকারকদের উপরও ট্যারিফের প্রভাব পড়বে না। আমাদের দেশ থেকে রপ্তানি হওয়া বেশিরভাগ পণ্যের, বিশেষত তৈরি পোশাক, পরিবহন ব্যয় বহন করে সংশ্লিষ্ট দেশের আমদানিকারক। রপ্তানি হয় ফ্রেইট অন বোর্ড (এফওবি) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ পণ্য পরিবহন বা শিপিং ব্যয় বহন করবে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক। আমাদের দেশ থেকে রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি এ পদ্ধতিতে হয়ে থাকে।
আপাত দৃষ্টিতে ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় বাড়বে মনে হলেও এর প্রকৃত ইতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। একসময় বন্দরে জাহাজ জট ও কনটেইনার জট হতো। দীর্ঘ সময় বহির্নোঙরে অবস্থানের জন্য জাহাজ অপারেটর ও আমদানিকারকদের বাড়তি ব্যয় গুণতে হত। প্রতিটি জাহাজকে একদিন বর্হিনোঙরে অবস্থানের জন্য ১৫,০০০ ডলার চার্জ গুণতে হত, ৬-৭ দিনে এ চার্জ প্রায় ৯০,০০০ থেকে ১ লাখ ডলারে পৌঁছাত। কনটেইনার খালাস ও বোঝাই করতেও সময় লাগতো বেশি। এ বাড়তি ব্যয়ের প্রভাব পড়তো ভোক্তার উপর।
সংকট কাটাতে সরকার আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত করার পাশাপাশি যোগ করেছে নিত্য নতুন প্রযুক্তি ও টার্মিনাল, বাড়িয়েছে সেবা প্রদানের গতি। আগে যেখানে বহির্নোঙরে একটি জাহাজকে পণ্য খালাসে ৬-৭ দিন অপেক্ষা করতে হত, সেখানে এখন অন-অ্যারাইভাল বার্থিং (জাহাজ আসার সাথে সাথে) পাচ্ছে জাহাজগুলো। এছাড়া টার্ণ অ্যারাউন্ড টাইম নেমে এসেছে ২ থেকে আড়াই দিনে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে জাহাজ কনটেইনার খালাস ও বোঝাই করে পুনরায় যাত্রা করতে পারছে। ফলে আমদানিকারকরা দ্রুততম সময়ে তাদের পণ্য হাতে পাচ্ছেন। গুনতে হচ্ছে না বাড়তি খরচ। এতে তারা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি ভোক্তাদের উপরও বাড়তি ব্যয়ের চাপ তৈরি হচ্ছে না। বরং এতে যে অর্থ সাশ্রয় হয়, তাতে পণ্যের মূল্য আরো কমানোর সুযোগ থাকে।
সরকারের নির্দেশনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ এসব সেবা প্রদানের গতি আরও বাড়াতে কাস্টমসের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে। জোর দিচ্ছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে। এছাড়া সেবা প্রদানে পাশাপাশি জাহাজ চলাচল, বড় জাহাজ ভিড়ানো, ডিরেক্ট শিপিং বাড়াতে কাজ করছে সরকার। ডিরেক্ট শিপিং ও বড় জাহাজ ভিড়ানো গেলে অধিক সংখ্যক কনটেইনার একসাথে পরিবহন সম্ভব হবে, এতে পরিবহন খরচ বাঁচবে ৪০-৫০ শতাংশ।
ট্যারিফ বৃদ্ধির ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় বাড়লে দেশের আয়ও বাড়বে: কারণ বন্দরের আয় থেকে শুল্ক ও আয়কর বাবদ বিপুল অর্থ পেয়ে থাকে সরকার। যা সরকার দেশের মানুষের উন্নয়নে ব্যয় করে, অর্থাৎ প্রকৃত সুফলভোগী সাধারণ মানুষ। এছাড়া পরিকল্পনাধীন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাবে নিজস্ব অর্থায়নে। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লগ্নী করলে এর কাঙ্খিত সুফল পাওয়া যায় না।
বিগত ২৫ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর বিভিন্ন খাতে সরকারকে প্রায় ২৩,৪১১ কোটি টাকা দিয়েছে। এর মধ্যে কর্পোরেট ট্যাক্স হিসেবে ৯,০৯২ কোটি, ভ্যাট হিসেবে ৫,০৪৫ কোটি, ভেন্ডর থেকে কর্তনকৃত ভ্যাট ১,০৬৪ কোটি, আয়কর ৮১৫ কোটি, নন-ট্যাক্স রেভিনিউ ১,২৫৫ কোটি টাকা। সরকারের চাহিদা অনুযায়ী দুই দফায় ৪,৮০০ কোটি এবং পায়রা বন্দরের উন্নয়নে ৪৬২ কোটি টাকা দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। এছাড়া পৌরকর হিসেবে ৮৩১ কোটি ও এলডি ট্যাক্স হিসেবে ৪৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এ তথ্য থেকে বোঝা যায় চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব বাড়লে, দেশের রাজস্ব আয়ও বাড়ে।
ত্বরান্বিত হয় দেশের উন্নয়ন। ধারাবাহিক উন্নয়নে আর্শীবাদ নাকি বাধা—এমন প্রশ্নের জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষ মনে করেন, ট্যারিফ সমন্বয়ের ফলে আগের চাইতে আরও দক্ষতা ও দ্রুততার সাথে সেবা প্রদানে বন্দরকে মনোযোগী হতে হয়েছে। বিনিয়োগ করতে হচ্ছে বন্দর সম্প্রসারণ, প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি সংযোজনের জন্য। ফলে সবগুলো সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের ব্যয় কমছে, বাজারে পণ্য দ্রুত সময়ে পৌঁছাচ্ছে।
সামঞ্জস্যপূর্ণ ট্যারিফ কাঠামো না থাকলে একদিকে যেমন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকতে হয়, তেমনি অর্থায়ন সংকটে প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি তথা সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হয় না। ফলে ট্রেডিশনাল পদ্ধতিতে সেবা প্রদানের ফলে সেবার মান কমে যায়, পণ্য পরিবহনে সময় লাগে বেশি, বাড়ে খরচও। এর প্রভাব গিয়ে পড়ে ভোক্তাদের ওপর। তাই আমাদের প্রয়োজনেই বাস্তবভিত্তিক ট্যারিফ সমন্বয় করতে হয়েছে।
টেকসই, বাস্তবভিত্তিক, প্রয়োগিক ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ ট্যারিফ পলিসি প্রণয়নের সুযোগ পৃথিবীর প্রত্যেকটি আন্তর্জাতিক বন্দরের প্রাতিষ্ঠানিক ট্যারিফ পলিসিতে রয়েছে। ফলে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে পরিচালন ব্যয় ও বাজার ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে ট্যারিফ রিভিউ হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দীর্ঘ ৪০ বছর পর ট্যারিফ রিভিউ করায় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এবারের ট্যারিফ রিভিউ ও বাস্তবায়নের সাথে বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড (পর্ষদ সভা) ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ট্যারিফ পলিসি প্রণয়নের ফলে ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা তৈরি হবে না। পলিসি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ান্তে ট্যারিফ রিভিউ হবে। ট্যারিফ একটি টেকসই, বাস্তবমুখী ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ রূপ পাবে।
সিদ্ধান্ত আমাদের, এগিয়ে যাব নাকি পিছিয়ে থাকব: শুধুমাত্র আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য নয়। বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাবে রূপান্তরের যে ভিশন সরকার হাতে নিয়েছে, তা বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম বন্দরকে গড়ে তুলতে হবে বিশ্বমানে। তবেই বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে সেবা প্রদানে সক্ষমতা আরও বাড়বে। নতুবা আমরা ট্রেডিশনাল বন্দর হিসেবে পিছিয়ে থাকব।
অতএব, অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির সংযোজনের পাশাপাশি আর্থিক কাঠামোতেও প্রতিযোগিতাপূর্ণ অবস্থানে থাকতে হবে। আমরা যদি বর্হিবিশ্বের সাথে টিকে থাকতে চাই, তাহলে আমাদের বন্দর সেবায় প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। থাকতে হবে আর্থিক সক্ষমতা, বাস্তবভিত্তিক ও টেকসই আর্থিক কাঠামো। যা সেবার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগও নিশ্চিত করবে।
গ্রীন শিপিং কিংবা গ্রীন পোর্ট ধারণার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের এখনই এ খাতে নজর দিতে হবে। তবেই হাই-এন্ড প্রোডাক্টের ম্যানুফ্যাকচারিং হাবের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, স্পীড টু মার্কেট অর্জন সম্ভব হবে। বাড়বে দেশের উৎপাদন সক্ষমতা, সাথে কর্মসংস্থানও। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সম্ভবনাময় বন্দর হিসেবে আগামীতে চট্টগ্রাম বন্দর নেতৃত্ব দিবে এ অঞ্চলের নৌপরিবহন খাতে।
এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর ট্যারিফের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত নতুন ট্যারিফ প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে চট্টগ্রাম বন্দরকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেবে। বাড়বে কর্তৃপক্ষের আর্থিক সামর্থ্য। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজস্ব বিনিয়োগেও প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতাও বাড়বে। বাড়বে দেশের মানুষের কর্মসংস্থান, বৈদেশিক আয় এবং সর্বশেষে দেশের রাজস্ব।