শিক্ষা সমতা: দয়া নয়, নাগরিকের মৌলিক অধিকার

Any Akter
এম এ মতিন
প্রকাশিত: ৪:২০ অপরাহ্ন, ২২ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ৪:৪৬ পূর্বাহ্ন, ১৪ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ভূমিকাঃ- দয়া নয়, অধিকার

একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে এমন একটি বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—এই দেশে মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া এখনো কোটি মানুষের কাছে অধরা। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র অনেকসময় শিক্ষা নিয়ে কথা বলে “উন্নয়ন প্রকল্প” বা “সুবিধা” হিসেবে, কিন্তু এটি আসলে একটি অপ্রতিরোধ্য অধিকার, যা কোনও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অপেক্ষায় থাকবে না।

আরও পড়ুন: গণ আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে হতাশার মুখোমুখি

শিক্ষা সমতা হচ্ছে মৌলিক মানবাধিকার, যা সংবিধান স্বীকৃত, জাতিসংঘ ঘোষিত এবং নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে, এই অধিকার এখনো বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

১. সাংবিধানিক ও নীতিগত কাঠামোঃ-

আরও পড়ুন: জম্মু-কাশ্মীর: আলাদা পরিচয় থেকে জাতীয় মূলধারায়

সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদ বলছে:

সকল নাগরিকের জন্য একীভূত ও সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে

শিক্ষা হবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক

অসাম্য দূর করে শিক্ষা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে

তবে এই অনুচ্ছেদ “ন্যায়বিচারযোগ্য নয়”—অর্থাৎ, আদালতে এ অধিকার দাবি করা যায় না। ফলে শিক্ষা একটি মৌলিক নীতির অংশ হলেও, আইনগত প্রতিকারহীন একটি প্রতিশ্রুতিতে রূপ নিয়েছে।

    * ১৯৯০ সালের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন কেবল ৬–১০ বছরের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য।

    * মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষা স্তরে কোনো বাধ্যতামূলক আইন নেই।

২. প্রবেশ, ঝরে পড়া ও শিক্ষার মান: পরিসংখ্যানে বাস্তবতাঃ-

সূচক তথ্য

প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি (Net Enrolment) ৯৭.৭% (২০২১)

মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে মাত্র ৬৪%

দশ বছর বয়সে গ্রেড-উপযুক্তভাবে পড়তে পারে মাত্র ৪৩%

স্কুল ড্রপআউট প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ

মাধ্যমিকে মেয়েদের ড্রপআউট প্রায় ৪০.৮%

গ্রামে গ্রেড রিপিট ৭৪% পর্যন্ত

* অর্থাৎ, ভর্তি হার ভালো হলেও, মান ও ধারাবাহিকতা ভয়াবহ দুর্বল।

* ড্রপআউট বা ঝরে পড়া:

প্রতিবছর ২০ লাখের বেশি শিশু স্কুল ছাড়ে

মূল কারণ: দারিদ্র্য, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, স্কুল অবকাঠামোর দুর্বলতা

কিশোরী মেয়েদের ড্রপআউট হার ৪১% এর কাছাকাছি — ভয়াবহ

৩. শহর বনাম গ্রাম: বৈষম্যের জ্বলন্ত উদাহরণঃ-

দিক শহর গ্রাম

প্রশিক্ষিত শিক্ষক অধিকাংশ অভাব

ডিজিটাল ক্লাসরুম ৮৯% মাত্র ৪১%

মৌলিক অংক ও পাঠে সক্ষমতা তুলনামূলক ভালো প্রায় ৮১% অক্ষম

বিদ্যালয় অবকাঠামো মানসম্মত জরাজীর্ণ ও অপর্যাপ্ত

 • শহরের স্কুলে থাকে প্রশিক্ষিত শিক্ষক, আইসিটি সুবিধা

গ্রামাঞ্চলের স্কুলে:

শিক্ষক সংকট

জরাজীর্ণ ভবন

বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের অভাব

অনেক উপজেলায় ৮০% শিক্ষার্থী মৌলিক অংক বা পড়ায় ব্যর্থ

* শহর ও গ্রামভিত্তিক শিক্ষার এই বৈষম্য শিশুদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে জন্মস্থানের ভিত্তিতে—যা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজের পরিপন্থী।

৪. লিঙ্গভিত্তিক অসমতা ও নারীর অংশগ্রহণঃ-

প্রাথমিক পর্যায়ে ৬২% নারী শিক্ষক, কিন্তু মাধ্যমিকে মাত্র ৩০% ও উচ্চশিক্ষায় ২৭%।

প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৭%।

বাল্যবিয়ে, যৌন হয়রানি, নিরাপত্তাহীনতা নারী শিক্ষার পথে বড় বাধা।

 * অনেক গ্রামীণ এলাকায় নারী শিক্ষক নেই বললেই চলে, ফলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে অভিভাবকরা।

৫. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা: বঞ্চনার অবিরাম চক্রঃ-

প্রতিবন্ধী শিশু:

মাত্র ১০% স্কুলে যায়।

নেই ব্রেইল বই, র‍্যাম্প, সহায়ক শিক্ষক, টয়লেট।

আদিবাসী জনগোষ্ঠী:

মাতৃভাষায় শিক্ষা নেই।

পাঠ্যপুস্তক শুধুই বাংলায়, সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়।

রোহিঙ্গা শিশু:

প্রায় ৪ লাখ শিশু এখনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

কোনো জাতীয় পাঠ্যক্রম বা আন্তর্জাতিক স্কুলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

৬. মাদ্রাসা বনাম সাধারণ শিক্ষা: শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্নিহিত বিভাজনঃ-

বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেকটি বড় বিভাজন হলো মাদ্রাসা শিক্ষা ও সাধারণ শিক্ষার মধ্যকার বৈষম্য। দুটি ধারার শিক্ষার মধ্যে পাঠ্যক্রম, সুযোগ-সুবিধা, মান এবং সামাজিক স্বীকৃতিতে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য, যা শিক্ষায় সমতা প্রতিষ্ঠার পথে এক বড় অন্তরায়।

বাংলাদেশে প্রায় ২০% শিক্ষার্থী মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ে।

দুটি ধারার মধ্যে রয়েছে গুরুতর বৈষম্য—

বিষয় সাধারণ শিক্ষা আলিয়া মাদ্রাসা কওমি মাদ্রাসা

বিজ্ঞান ও ICT বাধ্যতামূলক সীমিত অনুপস্থিত

কর্মমুখী শিক্ষা সম্প্রসারিত দুর্বল নেই

সরকারি স্বীকৃতি পূর্ণ সীমিত সীমিত ও জটিল

কর্মসংস্থানের সুযোগ বিস্তৃত সীমিত অতি সীমিত

পাঠ্যক্রম ও দক্ষতা সংকটঃ- 

আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা একদিকে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়, অন্যদিকে সীমিত সাধারণ জ্ঞান প্রদান করে। অপরদিকে, কওমি মাদ্রাসা সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় পাঠ্যক্রম-নির্ভর, যেখানে বিজ্ঞান, গণিত, ভাষা বা প্রযুক্তি                             বিষয়ক শিক্ষা প্রায় অনুপস্থিত।

ফলাফল: মাদ্রাসা শিক্ষার্থী দেশের মূলধারার কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে অক্ষম হয়ে পড়ে—শুধু ইমামতি বা ধর্মীয় খাতেই সীমাবদ্ধ থাকেন।

অনেক ক্ষেত্রে মাদ্রাসা থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভোকেশনাল দক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান, কিংবা চাকরির উপযুক্ততা নেই—যা তাদের অদক্ষ ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে।

সামাজিক বৈষম্য ও হীনমন্যতাঃ- 

সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকরি, স্কলারশিপ, উচ্চশিক্ষায় সুযোগ পেলেও, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হন।

ফলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সমাজে ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে নিজেকে দেখে—যা আত্মবিশ্বাস হ্রাস করে এবং সহিংস চরমপন্থা বা বেকারত্বের ফাঁদে ফেলতে পারে।

অবকাঠামো ও সুযোগের বৈষম্যঃ-

সাধারণ স্কুলে ডিজিটাল ক্লাসরুম, পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার থাকলেও—অধিকাংশ মাদ্রাসায় এসব অনুপস্থিত।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নেও রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি।

অনেক উপজেলায় দেখা যায়—মাদ্রাসাই একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অথচ সেখানে আধুনিক জ্ঞানের চর্চা হয় না।

৭. বাজেট: প্রতিশ্রুতি আছে, প্রাধান্য নেইঃ-

UNESCO-এর সুপারিশ: জিডিপির ৪–৬% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ

বাংলাদেশ (FY ২০২৩–২৪): মাত্র ১.৮৩%

HRMI-এর শিক্ষা অধিকার সূচক অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষায় ৯৯% অধিকার বাস্তবায়ন সম্ভব হলেও মাধ্যমিকে তা ৬৩.৭% মাত্র।

* এর অর্থ—শিক্ষায় রাষ্ট্রের “ক্ষমতা” থাকলেও “ইচ্ছা” ও “অগ্রাধিকার” নেই।

৮. বাস্তব অভিজ্ঞতাঃ- কিছু কণ্ঠ

 “আমার মেয়ের স্কুলে নেই নারী শিক্ষক, নেই নিরাপত্তা। তাই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।” — পঞ্চগড়ের এক মা

 “আমি মাদ্রাসা থেকে পাশ করেছি, কিন্তু চাকরির জন্য কেউ সিভিও নেয় না।” — এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী

 “বৃষ্টিতে স্কুল বন্ধ, গরমে স্কুল বন্ধ — এরপর আর ক্লাস হয় কবে?” — কুড়িগ্রামের ছাত্র

৯. করণীয় ও নীতিগত সুপারিশঃ-

ক্ষেত্র সমস্যা সুপারিশ

আইনি অধিকার শিক্ষাকে বিচারযোগ্য অধিকার নয় সংবিধানে শিক্ষা অধিকারকে Fundamental Right হিসেবে অন্তর্ভুক্ত

বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৮৩% কমপক্ষে ৪–৬% বরাদ্দ নিশ্চিত

গ্রামীণ শিক্ষা শিক্ষক সংকট, অবকাঠামোর অভাব টিচার ট্রেনিং, ICT ইনফ্রা, পরিবহন সুবিধা

মাদ্রাসা শিক্ষা বৈষম্য ও অদক্ষতা সমন্বিত পাঠ্যক্রম, ভোকেশনাল শিক্ষা, স্কলারশিপ

প্রান্তিক গোষ্ঠী ভাষা, সুযোগ, নিরাপত্তাহীনতা মাতৃভাষায় শিক্ষা, ইনক্লুশন নীতি, সামাজিক কর্মসূচি

মান নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার মানের ঘাটতি নিয়মিত মনিটরিং, শিক্ষা মান নিরীক্ষা, স্থানীয় কমিটিকে সক্রিয় করা

উপসংহারঃ- শিক্ষা মানে সমতা, সম্মান, সংহতি

শিক্ষা কোন করুণা নয় — এটি একটি সাংবিধানিক ঋণ, যা রাষ্ট্র তার নাগরিককে পরিশোধ করতে বাধ্য।

যেখানে প্রতিটি শিশু, প্রতিবন্ধী বা প্রান্তিক, গ্রামীণ বা মাদ্রাসা ছাত্র—সমান সুযোগ, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হতে পারে, সেখানেই গড়ে ওঠে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক, দক্ষ ও মানবিক রাষ্ট্র।

*  “শিক্ষা সমতা ছাড়া জাতিগত সমতা সম্ভব নয়।

শিক্ষার অধিকার যদি শুধু প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে উন্নয়ন হবে প্রতারণা।”৷ 

লেখক -কলাম লেখক  ও সামাজিক বিশ্লেষক।