বিচার বিভাগে নজিরবিহীন বদলি, আতঙ্কে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বিচার বিভাগে চলছে নজিরবিহীন বদলি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে দেড় মাসের বেশি সময়ে চার শতাধিক বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। বিগত সরকারবিরোধী বিশেষ ঘরানার রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আরও তালিকা প্রস্তুত করার গুঞ্জনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে। পাশাপাশি এমন বদলি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
অভিযোগ উঠেছে, সরকার পরিবর্তনের পর মতাদর্শ বিবেচনায় নজিরবিহীন বদলি চলছে। শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তার ইচ্ছামাফিক ঢাকার বাইরে বদলি হয়েছেন অনেকে। তাদের জায়গায় পছন্দের লোককে এনে দল ভারী করার পাশাপাশি বিচার প্রশাসনে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে।
আরও পড়ুন: সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
এভাবে নজিরবিহীন বদলির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই বিচার বিভাগে শৃঙ্খলার ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ক্ষেত্রবিশেষ সরকারি বিধিবিধানও অনুসরণ করা হচ্ছে না। আবার এতদিন নিজেদের আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেওয়া কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা রাতারাতি ভোল পাল্টে বিএনপি সমর্থক হয়ে অন্যদের ‘শায়েস্তা’ করার জন্য মরিয়া। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ।
এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ কঠোর অবস্থানের জানান দিয়েছেন। গত ২১ সেপ্টেম্বর অভিভাষণে দুর্নীতিকে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করেন তিনি।
আরও পড়ুন: ১৮ বছর আগে বরখাস্ত ৩২৮ নির্বাচন কর্মকর্তা চাকরিতে পুনর্বহারের নির্দেশ আপিল বিভাগের
সরকার পরিবর্তনের পর গত ৬ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। এ বৈঠকে দীর্ঘদিন একই চেয়ারে থাকা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বদলির সিদ্ধান্ত হয়। তবে একসঙ্গে বড় ধরনের বদলির আদেশ দেওয়া হলে পুরো বিচার বিভাগে স্বাভাবিক কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিতে পারে– এমন আশঙ্কাও রয়েছে। প্রথম ধাপে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী তিন বছর বা তারও বেশি সময় ধরে একই স্থানে রয়েছেন, তাদের এবং যেসব কর্মকর্তা লাঞ্ছনার আশঙ্কা করছেন, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে সম্ভাব্য নিরাপদ স্থানে বদলি করার সিদ্ধান্ত হয়।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত ২৯ আগস্ট পৃথক চারটি গেজেটে ৮১ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। পরে ২ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে বদলি করা হয় পাঁচ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে। ৮ সেপ্টেম্বর একাধিক প্রজ্ঞাপনে বিভিন্ন পর্যায়ের ২২৪ বিচারককে বদলি করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর বদলি হন চারজন জেলা জজ। ২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে বদলি করা হয় আইন ও বিচার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ ওসমান হায়দারকে। পরদিনই বদলি করা হয়েছে ঢাকার বাইরে থাকা ১৪ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাকে (জেলা জজ)।
এ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার ও যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহাকে ওএসডি করা হয়েছে। আগামী ১১ নভেম্বর পর্যন্ত আইন সচিবের চাকরির মেয়াদ ছিল।
এরই মধ্যে বদলি হওয়া উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন– আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বেগম উম্মে কুলসুম, যুগ্ম সচিব ড. শেখ গোলাম মাহবুব, যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবির, নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (জেলা জজ) মো. আল মামুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এমএলবি মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, উপসচিব (মতামত) এমদাদুল হক, উপসচিব মোহাম্মদ আলী, সলিসিটির রুনা নাহিদ আকতার, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের সচিব শেখ আবু তাহের, নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম সচিব মাহবুবুর রহমান সরকার, ঢাকার সিএমএম মোস্তাফিজুর রহমান সোহেল, সিজিএম রেজাউল প্রমুখ। এ ছাড়া রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার ব্যারিস্টার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান, হাইকোর্ট বিভাগের ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. শামীম সুফী ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৃহৎ আকারে এমন বদলির সিংহভাগ ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার প্রতিফলন ঘটেনি। অথচ আইন মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ডেপুটেশনে থেকে বিচারের মূল কাজ থেকে দূরে রয়েছেন এমন একাধিক কর্মকর্তাও মন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। সলিসিটর উইংয়ের প্রধান ছাড়াও বাকিসহ কর্মকর্তা দীর্ঘ বছর কর্মরত থাকলেও তাদের একজনকেও বদলি করা হয়নি।
এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, এভাবে বদলি নজিরবিহীন। দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতিহিংসাবশত বদলি করা হচ্ছে। এর ফলে বিচারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অবশ্য একে চলমান প্রক্রিয়া বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (আইন ও বিচার বিভাগ) সচিব মো. গোলাম রব্বানী।
তিনি বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে এক জায়গায় আছেন, তাদের বদলি করা হয়েছে। অনেকে নিজেরাই বদলি হয়েছেন। কিছু সমস্যা ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া যারা চার-পাঁচ বছরের ওপরে এক জায়গায় ছিলেন, তাদের এবং তিন বছরের বেশি সময় যারা আছেন, তাদেরও পর্যায়ক্রমে বদলি করা হবে। বিচারকদের একই জায়গায় ৯-১০ বছরের বেশি থাকা বেমানান।