এডিসি শাহিদুরের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ। আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু সহ আরো কয়েকজন জড়িত।
এমপি আনারের মেয়ে ডরিনের তথ্যে তদন্তে নতুন মোড়

ঝিনাইদহ ৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার অপহরণ ও হত্যা মামলার তদন্তে সরাসরি কিলারদের দুই দেশের তদন্ত সংস্থা চিহ্নিত করলেও পরিকল্পনাকারী ও মোটিভ উদ্ধার করতে পারেনি এখনও। তবে নিহত এমপির মেয়ে ডরিণের দেওয়া তথ্য থেকে তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মিন্টু সহ আরো কয়েক প্রভাবশালী নেতা সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বর্ণের ব্যবসায়ীর গড ফাদার এতে জড়িয়ে যেতে পারে।
আনার কন্যা ও শেরে বাংলানগর থানায় দায়ের করা মামলার বাদী মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের তথ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ঝিনাইদহের আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবু। তাকে গ্রেপ্তারের পর ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাঈদুল করিম মিন্টুসহ আরও কয়েকজনের নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বলেছেন ডরিন। তার দাবী মিন্টুর সঙ্গে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) মো. শাহিদুর রহমানের বিশেষ সখ্য রয়েছে। এই অভিযোগ পাওয়ার পর শাহিদুরকে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা থেবে বরিশালে বদলী করা হয়েছে। গতাকল পর্যন্ত তিনি ডিবি থেকে ছাড়পত্র নেননি। এডিসি শাহিদুরের বিরুদ্ধে এই মামলার তদন্তে মূল আসামিদের আড়াল করে এলাকায় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি করার অভিযোগ রয়েছে। এডিসি শাহিদুরের বাড়িও একই এলাকায় এবং তিনি সকলের পরিচিত। এমপি কন্যা ডরিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলে সব অভিযোগ করেছেন।
আরও পড়ুন: সরকারি কর্মচারীদের বেতন সমন্বয়ে জাতীয় বেতন কমিশনের প্রথম সভা আজ
ডরিন জানান প্রধানমন্ত্রী তাকে টেলিফোন করে যে কোন বিষয়ে জানাতে বলেছেন। ডরিন দিল্লি অবস্থানকারী প্রধানমন্ত্রীকে সবকিছু অবহিত করেছেন।
ডরিন বাংলাবাজার পত্রিকা কে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি সবকিছু অবহিত করেছি। এখনও এসডিসি শাহিদুরকে মামলা থেকে প্রদান না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন সে মামলাটিকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করছে। আমি পারিবারিকভাবে প্রাপ্ত সকল বিষয়ে তথ্য মন্ত্রী মহোদয়কে অবহিত করেছি।
আরও পড়ুন: সেনাবাহিনী প্রধানের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই: আইএসপিআর
এবিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডরিন তার বাবাকে হারিয়েছেন। তার মধ্যে আবেগ কাজ করছে। তিনি আমাদেরকে কিছু তথ্য দিয়েছেন। আমরা সেগুলো যাচাই বাছাই করছি। মামলার তদন্ত চলবে তার নিজস্ব গতিতে। আজ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত শেষে অনেকেই গ্রেফতার হতে পারেন। সংসদ সদস্য আনারের মরদেহের সন্ধান মিললে এ সংক্রান্ত আরও অনেক তথ্য প্রকাশ করা হবে।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সত্যের কাছাকাছি এসে গিয়েছি। মরদেহের বিষয়টি নিশ্চিত হলেই আমরা আপনাদের কাছে অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারব। মরদেহ নিশ্চিত হওয়ার জন্য যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের জবানবন্দি শুনেছি। তারা বলেছে যে, মরদেহ তারা খণ্ডবিখণ্ড করেছে। কোথায় রেখেছে, সেটা নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। ভারত ও আমাদের গোয়েন্দারা সেখানে গিয়েছিল। সেখান থেকে তারা যেগুলো পেয়েছেন, সেগুলো উদ্ধার করেছেন। ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হতে পারব না যে এগুলো তার মরদেহের অংশ।’
জানা গেছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বাবার সন্দেহভাজন কয়েক আসামির নাম পরিচয় জানিয়েছেন ডরিন। মামলার তদন্তে ডিবির প্রতি সন্তুষ্ট হলেও ডিবির এক কর্মকর্তার ব্যাপারেও অভিযোগ করেছেন তিনি। ওই কর্মকর্তার বাড়ি আনারের নির্বাচনী এলাকায়।
এবিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মামলার বাদি হিসেবে ডরিনের বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। আর ওই এডিসিকে শিগগিরই বদলিকৃত জায়গায় যোগদান করতে বলা হয়েছে। ডরিনের অভিযোগ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা না হয়েও তদন্তে নাক গলানো এডিসি শাহিদুর রহমান রিপন তার বাবার হত্যাকারীদের কৌশলে গ্রেপ্তার এড়িয়ে সুযোগ করে দিয়েছেন। আসামি শিমুলের বক্তব্য সঠিকভাবে রেকর্ড করতে দেননি।
এমপি আনোয়ারুল আজিম আনোয়ার হত্যাকাণ্ডে ঢাকায় দায়ের করা অপহরণ মামলার তদন্তে নেমে ডিবি গ্রেফতার করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা শিমুল ভূঁইয়া, তার ভাতিজা তানভীর ও মডেল সিলাস্তি রহমানকে। দুই দফা রিমান্ড শেষে নিজেদের জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দেয়ার পর তারা এখন কারাগারে।অপরদিকে কলকাতার সিআইডি গ্রেপ্তার করে কসাই জিহাদকে আর নেপালি সিয়ামকে আটক করে কাঠমান্ডু পুলিশ। ঢাকায় নতুন করে গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল আহমেদ গ্যাস বাবু। ঝিনাইদহের আরো এক আওয়ামী লীগ নেতাকে নিজের বাবার হত্যার বেনিফিশিয়ারি হিসেবে হত্যাকারী সন্দেহ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানিয়েছেন আনারের মেয়ে ডরিন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বাবার হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করতে দাবি জানাবে এটাই স্বাভাবিক সেই সন্দেহভাজনদের নাম বলেছে আমরা তার বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।
কলকাতার নিউটাউনের বাসায় শুয়ারেজ লাইন থেকে খন্ডিত মাংস উদ্ধার করলেও এখনো তার ডিএনএ পরীক্ষা হয়নি। তবে সেখানকার একটি খাল থেকে উদ্ধার হওয়া হাড়গোড় এমপি আনারের কিনা জানতে পাঠানো হয়েছে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে।
শিমুলকে ২ কোটি দেওয়ার কথা ছিল গ্যাস বাবুর :
কিলিং মিশন বাস্তবায়নকারীদের দুই কোটি টাকা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুর। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের প্রতিনিধি হিসাবে হত্যা পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহকে এই টাকা দেওয়ার কথা ছিল। রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য জানিয়েছেন গ্যাস বাবু।
আনার হত্যার পরিকল্পনায় শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে বৈঠকও করেছেন গ্যাস বাবু। আনার হত্যার পর টাকা দেওয়ার আগেই আত্মগোপনে চলে যান বাবু। শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে বাবুর টাকা লেনদেনের কথোপকথনের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটিংয়ের বেশ কিছু স্ক্রিণশর্ট পেয়েছে তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এছাড়া শিমুল ভূঁইয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তদন্ত সূত্রের তথ্য মতে, কলকাতার সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে সংসদ-সদস্য আনারকে হত্যা ও লাশ গুমের পর ১৫ মে বাংলাদেশে আসেন শিমুল ভূঁইয়া। এ সময় শিমুল ভূঁইয়াকে শাহীন বলেন, বাবুর কাছ থেকে দুই কোটি টাকা নিতে। ১৬ মে বাবুর সঙ্গে এ বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন শিমুল ভূঁইয়া। ১৭ মে তারা ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে পরস্পর গাড়ির ভেতর সাক্ষাৎও করেন। সেসময় বাবু বলেন, ২৩ মে দুই কোটি টাকা শিমুল ভূঁইয়াকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কোনো কারণে ওইদিন দিতে না পারলে ২৬ মে টাকা দেবেন। তবে ২০ মে এমপি আনার হত্যার বিষয়টি প্রকাশ পেলে তারা আত্মগোপনে চলে যান।
এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা বাবু বুধবার ঝিনাইদহ সদর থানায় তার যে তিনটি ফোন হারানোর জিডি করেছেন, সে ফোনগুলো তিনি নিজেই ধ্বংস করেছেন বলে জানায় ডিবি। এমপি আনার অপহরণ মামলায় ডিবি শনিবার বাবুকে গ্রেফতার করেছে।
সাভারে অভিযান:
আলামত উদ্ধারে ডিবি গতকাল তানভীর ভূঁইয়ার সাভারের লুটের চরে ভাড়া বাসায় অভিযান চালায়। ওই বাসা থেকে একটি মোবাইল ফোন পায় ডিবি। মোবাইল ফোনের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আনার হত্যার পর ১৬ মে হোয়াটসঅ্যাপে বাবুর সঙ্গে শিমুল ভূঁইয়ার যোগাযোগ ও কথোপকথনের তথ্য রয়েছে। তারা আনারকে অপহরণ এবং পরে হত্যাসংক্রান্ত ছবি, টাকাপয়সা লেনদেন বিষয় নিয়ে গোপন বৈঠক করে। তাদের পরিকল্পনার সঙ্গে আরও কেউ জড়িত আছেন কি না, সেটা জানতে চাইলে আসামি বাবু ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে বিভ্রান্ত করেন।
প্রসঙ্গত গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যান ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। সেখানেই নিখোঁজ হন তিনি। ১৮ মে পশ্চিমবঙ্গের বরানগর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন তার বন্ধু বরানগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস। ২০ মে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে আনারকে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করার তথ্য জানায় ভারতীয় পুলিশ। গ্রেপ্তার হওয়া ঘাতকদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, ১৩ মে দুপুরেই আনারকে হত্যা করা হয়েছে।