রায়হান বাদশার দাপটে দিশেহারা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর
শিক্ষা প্রশাসনে ঘুষ ছাড়া সেবা নেই

শিক্ষা প্রশাসনে ঘুষ ছাড়া সেবা মেলে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ ১৩টি প্রতিষ্ঠানের সর্বত্র ঘুষ বাণিজ্যে সক্রিয় ২০টি সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটে জড়িত দুই শতাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে আঞ্চলিক শিক্ষা অফিস, শিক্ষা ভবন এমনকি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে এদের প্রভাব। স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকের এমপিওভুক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণসহ অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের পেনশনের জন্য টাকা গুনতে হয়। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ, মেরামত, আসবাবপত্র ও শিক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা ও সরবরাহের কাজের প্রতিটি ধাপেই চলে সীমাহীন দুর্নীতি।
আরও পড়ুন: ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবন সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা
সাবেক পূর্তমন্ত্রীর স্ত্রী ও ভাইয়ের ইশারায় দুর্নীতির রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা হয় শিক্ষা অধিদপ্তর। ওই মন্ত্রীর স্ত্রী সাবেক মহাপরিচালকের অনুসারীরা এখনও শিক্ষা প্রশাসনে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। কিছুদিন যারা সুবিধাভোগী ছিলেন, তাদের কেউ কেউ আবার ভোল পাল্টে নতুন রুপে হাজির হয়েছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, সেই সরকারের হয়ে যান এসব সুবিধাভোগী দুর্নীতিবাজরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, সকল শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিসহ (নায়েম) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে পতিত সরকারের সুবিধাভোগীরা। অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদত্যাগ করলেও চলতি দায়িত্ব প্রাপ্তদের নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত: ট্রাইব্যুনালের অভিমত
এদিকে, ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনার দোসর বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদ নেতা ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত রায়হান বাদশা বাগিয়ে নিয়েছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর প্রধানের পদ। এতে জনমনে প্রশ্ন- কিভাবে পেলেন তিনি এই পদ? এর নেপথ্য রহস্য কী? গত ২৫ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আম্বিয়া সুলতানার স্বাক্ষরে তাকে নিয়োগদানপূর্বক (চলতি দায়িত্ব) প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
জনরোষে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার একান্ত অনুসারী দুর্নীতি পরায়ন এই প্রকৌশলী নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর। তিনি মুজিব শতবর্ষ লোগো ব্যবহার করেই মন্ত্রণালয়ে চিঠিপত্র দাখিল করেছেন। যাতে লেখা ‘শিক্ষা নিয়ে গরব দেশ শেখ হাসিনার বাংলাদেশ’।
গোপালগঞ্জের জামাতা মো. রায়হান বাদশাকে গুরুত্বপূর্ণ এ দফতরের প্রধানের দায়িত্ব দেয়ায় চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে।
সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান প্রকৌশলীর (চলতি দায়িত্ব) অপকর্মের প্রতিবাদকারীদের বিতাড়নের জন্য এরই মধ্যে কালো তালিকা করা হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের দুঃশাসনে যারা এতোদিন নির্যাতিত হয়েছেন তাদের অনেকের নাম আছে এই তালিকায়। বৈষম্যের শিকার প্রকৌশলীরা আছেন এক রকম আতঙ্কে। রায়হান বাদশার অনুসারীরা ইতোমধ্যে অনেক প্রকৌশলীকে দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন। ভীত প্রকৌশলীদের অনেকেই অফিসে হাজির হলেও অবস্থান করছেন স্বল্প সময়।
ক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য দুর্নীতিমুক্ত ও জনবান্ধব সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। রাষ্ট্রের দুর্নীতিবাজদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। আইনের শাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু গত সরকারের সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিবাজদের পুনর্বাসনে একটি চক্র সক্রিয় ।
প্রভাবশালী রায়হান বাদশার জন্ম নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে। পড়তেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট)। প্রকৌশলী হয়ে যোগদান করেন সরকারি চাকরিতে। দীর্ঘ ১০ বছর চাকরি করেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান গোপালগঞ্জে। বিয়ে করেছেন ওই জেলাতেই। প্রকৌশলীরা তাকে চেনেন গোপালগঞ্জের জামাতা হিসেবে। শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই নূর ই আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) তার খুঁটি। যিনি গত অবৈধ সংসদের চিফহুইপ ছিলেন। লিটন চৌধুরীর আশির্বাদে রায়হান বাদশা গোপালগঞ্জ থেকে ঢাকায় এবং শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে আসেন। প্রধান প্রকৌশলীর পরের পদেই বসেন। সাংগঠনিকভাবেও তিনি বেশ প্রভাবশালী। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের আহবায়ক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ২০২২ সালে।
নতুন দায়িত্ব পাবার আগ পর্যন্ত তিনি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঢাকা সার্কেলের দায়িত্বে ছিলেন। ১৭ জেলা ছিল তার নিয়ন্ত্রণে।
প্রধান প্রকৌশলী হতে এর আগেও রায়হান বাদশা চেষ্টা করেছিলেন। তার হয়ে তদবির করেছিলেন লিটন চৌধুরীরও। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক দায়িত্ব পান প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার। ৫ আগষ্ট হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালানোর পর গত ১৩ আগস্ট পদত্যাগ করেন দেলোয়ার মজুমদার। এর পর তিনি এ পদটি বাগিয়ে নেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি সরকার আমলে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েছিলেন এই রায়হান বাদশা।
নির্বাচিত কলেজসমুহের উন্নয়ন (সরকারি ও বেসরকারি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজের নতুন ছাত্রীনিবাস নির্মাণের কাজ ১২ মার্চ ২০০৬ সালে সমাপ্ত হয়। কিন্তু তা হোস্টেল কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে না দিয়েই ওই বছরের (১৫ জুন ২০০৬) ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজস করে পুরো বিল ছাড় করে দেন। এ বিষয়ে তদন্তের পর রায়হান বাদশাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে দলীয় নেতা হিসাবে সাজা প্রত্যাহার করা হয় রায়হান বাদশার। দেয়া হয় ঢাকাসহ ১৭ জেলার সমন্বিত পদে।
জানা গেছে, গত ১৫ বছরের মধ্যে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে। ফলে রায়হান বাদশাদের মতো সুবিধাভোগীরা এখনও বহাল থাকায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে অনিয়ম-দুর্নীতিও বেড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে কয়েক দফা ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ঘুষ ছাড়া কিছুই হয় না। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কিংবা কিন্ডার গার্টেনের অনুমতি নিতে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। হাই স্কুল ও কলেজের ক্ষেত্রে এই ঘুষের পরিমাণ সর্বনিম্ন ২ লাখ টাকা। কোনো কারণে প্রতিষ্ঠান বা নির্দিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে অনুদান বা বেতন বন্ধ হয়ে গেলে তা পুনরায় চালু করতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। পেনশনের কাগজপত্র প্রক্রিয়ায় ঘুষ লাগে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিতে চাইলে কমবেশি ২০ ধাপে ঘুষ দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ‘ইতিবাচক পরিদর্শন রিপোর্ট’ করিয়ে নিতে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেওয়া এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেটে। এমপিওভুক্তির কাজে একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ন্যূনতম ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনে ছেড়ে দেওয়ার পর এই ঘুষ বাণিজ্য আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে শিক্ষকদের হয়রানির মাত্রাও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। এছাড়া নাম, বয়সসহ নানা বিষয় সংশোধন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে ফাইল পাঠাতে ঘুষ দিতে হয় ৮-১০ হাজার টাকা। জেলা শিক্ষা অফিসে দিতে হয় ৫-৭ হাজার টাকা।