গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী এই কালো আইনের প্রয়োগে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্যোগ
৯ নারীসহ ডিটেনশনে ৩৭

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হঠাৎ করেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ প্রয়োগ শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক মাসে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তির আটকাদেশের প্রতিবেদন আসলেও সারাদেশে ৯ নারীসহ ৩৭ জনকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনে আটকের খবর পাওয়া গেছে। এদিকে আইন ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞগণ ঢালাওভাবে এই কালো আইনের প্রয়োগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেশে নিবর্তনমূলক এসব আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া মডেল মেঘলা আলমের আটকের বিষয়টি আলোচনায় সমালোচনায় আসলেও অনুসন্ধানে জানা যায় গত এক মাস ধরেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ প্রয়োগ শুরু করেছে। দেশের সকল মানবাধিকার সংগঠন ও আইনবিদরা এই আইনটিকে কালো ও নিবর্তনমূলক হিসাবে চিহ্নিত করায় প্রায় দুই যুগ ধরে এই আইনটির কোন প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার জঘন্য পুলিশী শাসনেও এই আইনের প্রয়োগ দেখা যায়নি। হঠাৎ করে কেন ঢালাওভাবে এটির ব্যবহার শুরু হয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তাগণ। মডেল মেঘনা আলমের আটক ও ডিটেনশনের বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়নি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যের পর সরকারের টনক নড়ে।
এরপর থেকেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ অগ্রগতির কাজ স্থবির হয়ে পড়ে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় গত এক মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটৈর মাধ্যমে অর্ধশতাধিক বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনের প্রতিবেদন এসেছে। দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে ৩৭ জন ব্যক্তি বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনে আছে। তন্মধ্যে ২৮ জন পুরুষ ও ৯ জন নারী ডিটেনশনে আছেন।
সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে আছেন তিনজন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার এক এ আছেন একজন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ২ এ আছেন চার জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে আছেন পাঁচজন নারী, কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন, গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন, নেত্রকোনা জেলা কারাগারে একজন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন, চাঁদপুর জেলা কারাগারে একজন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে তিনজন রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাতজন লালমনিরহাট জেলা কারাগারে একজন পঞ্চগড় জেলা কারাগারে দুইজন পটুয়াখালী জেলা কারাগারে একজন ও ভোলা জেলা কারাগারে দুইজন ব্যক্তি ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনে বন্দি আছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুধু গ্রেপ্তার করেই কারাগারে রেখেই ডিটেনশন নয়। কারাগারের বাইরে ব্যক্তিকেও ডিটেনশনের পক্ষ রাখার জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন আছে। ডিটেনশন অনুমোদন করে রাখার পর আটক করা মাত্রই তা কার্যকর হবে। ৩৭ জন নারী পুরুষ বিশেষ ক্ষমতা আইনে ডিটেনশনে কারাগারে বন্দি থাকলেও আরো বেশ কিছু লোকের বিরুদ্ধে আটকাদেশ দেওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখায় পাঠানো হয়েছে।
এ ধরনের অর্ধশত প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায়। এরই মধ্যে মেঘনা আলমের দেশ-বিদেশে ও মানবাধিকার কর্মীরা প্রতিবাদে তোলপাড় তৈরি করায় অন্যান্যদের অগ্রগতি থেমে গেছে বলে জানা গেছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ঢালাওভাবে কালো আইন হিসেবে চিহ্নিত ১৯৭৪ সনের বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন। তিনি বলেন, দেশের সকল শ্রেণির সচেতন মানুষ ও মানবাধিকার কর্মীরা এই আইনটিকে কালো আইন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে দীর্ঘ দুই যুগ ধরে এই আইনটির ব্যবহার দৃশ্যমান ছিল না। হঠাৎ করে অন্তবর্তীকালীন সরকার কেন এই কালো আইনটির ব্যবহার করতে গেল তা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ধরনের আইন গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর, মানবাধিকারকে সংকুচিত করে। এটির ব্যবহার দূরের কথা, দ্রুত এ ধরনের সকল আইন বাতিল করতে হবে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সাধারণ সম্পাদক ও পুলিশ সংস্কার কমিটির সদস্য নাসির উদ্দিন এলান বলেন, আমরা শুধু ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন না, এ ধরনের নিবর্তনমূলক সকল আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছি। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গড়ার একটি দায়বদ্ধতা নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ বা গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগণ তা অবশ্যই পালন করবেন। কিন্তু কাউকে আটকাতে নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ বা পুলিশের কাউকে আটক করতে মেঘনা আলম এর মত বাড়াবাড়ি করা উচিত না। গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের ও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী পুলিশের কার্যক্রমে তাদের নৈতিক মনোবল কমে গেছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশে ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বাধ্যতামূলক অবসরে ডিএমপির সাবেক ৯ ওসি
এজন্যে এই ধরনের আইনের প্রয়োগ অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি আরও বলেন, ঝটিকা মিছিল বা প্রত্যুষে মিছিল আগেও ছিল, এখনও হচ্ছে, এজন্য কালো আইনের ব্যবহার ঠিক হবে না। সুনির্দিষ্টভাবে মামলা বা গ্রেফতারি পরোয়ানার মাধ্যমে কাউকে আটক করতে হবে। প্রায় দুই যুগ ধরে বিশেষ ক্ষমতা আইনের কোন প্রয়োগ ছিল না। হঠাৎ করে কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটি ব্যবহার করছে তাও এ সরকারকে দেখা উচিত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে থেকে মাঠ পর্যায়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ দেয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সারাদেশেই এই আইনের কোন জেলায় কতজন প্রয়োগ করবে তার তালিকা ও অগ্রগতি নিয়মিত তদারকি করছে পুলিশ সদর দপ্তর।
তবে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মিডিয়া ইনামুল হক সাগর জানান, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ডিটেনশন দেওয়ার বিষয় পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে কোন ধরনের চিঠি ইস্যু করা হয়নি। মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্থানীয় বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত মতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটকাদেশ দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা বা তাদেরকে আটকাদেশ দেওয়ার বিষয় কোন ধরনের তথ্য নেই।
আরও পড়ুন: হাসিনার প্রিজম দিয়ে বাংলাদেশকে দেখায় ভারতকে মূল্য দিতে হচ্ছে