জুলাই অভ্যুত্থানের ঐক্য ফেরানোর তাগিদ

Sadek Ali
রাশেদুল হক
প্রকাশিত: ৯:১৯ অপরাহ্ন, ০৩ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, ১৩ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আর একমাস বাকি। এরই মধ্যে নানা ইস্যুতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরেছে। যে ঐক্যের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সকল রাজনৈতিক দল ও শ্রেণি, পেশার মানুষ আন্দোলন করেছিলেন, সেই ঐক্য আর এখন দেখা যাচ্ছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জুলাই সনদ, ও বিচার নিয়ে এরই মধ্যে কয়েকটি রানৈতিক দলের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়ব পদে ইশরাক হোসেনের বসা নিয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। এরই মধ্যে সামনে এসেছে নির্বাচনের টাইম ফ্রেম। বিএনপিসহ তাদের জোটেরর দাবি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আর জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন চায় পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। এছাড়াও তারা আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে এক রাখতে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ‘ঐক্য বজায় রাখা’র আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, যেকোন মূল্যে বীরের এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আসুন সবাই মিলে শহীদ জিয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করি, বাস্তবায়িত করি কোটি মানুষের নতুন বাংলাদেশের নির্মাণের স্বপ্ন। গত মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপি আয়োজিত জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শোক ও বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তির বিশেষ অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় তিনি এসব কথা বলেন। ভিডিও বার্তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।

আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত বুধবার বলেছেন, বিএনপি গত ১৬ বছরে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে আগামীতে আরও ছাড় দিতে রাজি আছে। এর আগের দিন তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক দলগুলো চিন্তা-ভাবনা করেই প্রস্তাব দিচ্ছে এবং সবাই জনগণের কথা চিন্তা করেই উত্তম প্রস্তাব দিচ্ছে। প্রত্যেক প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উত্তম কিনা, সেটি বিবেচনা করা দরকার। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক (প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তুলেছেন। বিশ্বের কোনো কোনো দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি রয়েছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় ভৌগলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এই পদ্ধতি কতটা উপযোগী তা সবাইকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর ধরে রাখতে হলে এবং তাঁবেদার মুক্ত রাখতে হলে জনগণের ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি ব্যবস্থায় দেশে ঐক্যর পরিবর্তে বিভক্তি, সমাজেও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠতে পারে কিনা তা গুরুত্বসহ সব রাজনৈতিক দলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করেছি।’ 

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের আড়ালে পুনরায় দেশের রাজনীতিতে নিজেদের অজান্তে পতিত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে কিনা তা-ও ভেবে দেখতে হবে।  ঐক্য ধরে রাখতে না পারার কারণ জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, “গত বছরের জুলাইয়ে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ৮০ ভাগ ছিল শ্রমজীবী মানুষ আর ২০ ভাগ উচ্চ শ্রেণির মানুষ। যে ৮০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ অংশ নিয়েছিলেন, তারা কিন্তু আন্দোলনের পর ঘরে ফিরে গেছেন। এখন সেই ঐক্য নিয়ে যারা দেনদরবার করছেন, তারা উচ্চ শ্রেণির। এখানে তাদের স্বার্থের সংঘাত আছে। ফলে তারা কখনো একত্রিত হতে পারবে না। কারণ, তাদের স্বার্থ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। ফলে, যেটা ঘটার ছিল, সেটাই ঘটেছে বলে আমি মনে করি।”

আরও পড়ুন: আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে বিদেশ যেতে দেয়া হয়নি

আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বেসরকারি সংস্থা খান ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রোকসানা খন্দকার গণমাধ্যমকে বলেন, “আজকে এই ঐক্যে ফাটল ধরার কারণ সরকার নিজেই। মানুষ যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলন করেছিল, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে সরকার অনেক দূরে। মানুষের মূল আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতন্ত্র পূণঃপ্রতিষ্ঠা। সেটা কি হয়েছে? আমরা বলতে পারি এখনো হয়নি। তরুণ সমাজকে এই এক বছরে আমরা কী দিতে পেরেছি? সরকারের উচিত হবে রাজনৈতিক দলগুলোর আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া।” বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি (সিপিবি)-র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স গণমাধ্যমকে বলেন, “মূলত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নিয়ে অভ্যুত্থান হয়েছিল, একটি গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা, আরেকটি হলো বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া। বৈষম্যহীন দেশ গড়ার কাজ তো শুরুই হয়নি। আর গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করতে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। সে পথেও এই সরকার এগোতে পারেনি।

জুলাই অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করা, শহীদদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া- এই কাজগুলো হচ্ছে, কিন্তু যে গতিতে হওয়া দরকার সেটা হচ্ছে না। সরকার আসলে যেসব কাজ করার দরকার নেই তারা সেই কাজে ব্যস্ত। ফলে নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম নেয়। সেই অবিশ্বাস থেকেই ঐক্যে ফাটল ধরে। সরকার চাইলে এখনো সেটা ফিরিয়ে আনতে পারে।” শুধুমাত্র বিএনপির কারণে সেই ঐক্য ধরে রাখা যায়নি বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন। তিনি বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রের ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশন দারুণ আন্তরিক। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও যখন কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে, তখন বিএনপি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাদের কারণেই জুলাই ঘোষণাপত্র করা যাচ্ছে না। তারা ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার কিছু বিষয় জিইয়ে রাখতে চায়। তাই আমরা বলেছি, সরকার যদি জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে না পারে, তাহলে আমরা সেটা দেবো।” তবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ইমরান সালেহ প্রিন্স  বলেন, “সেই ঐক্য পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। আমি মনে করি, এখনো আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পৃথক কর্মসূচি থাকবে, তারা সে অনুযায়ী কাজ করবে। একটি দেশে সবাই একটি বিষয়ে একমত হবে এমন তো না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান আসবে। কিন্তু আলোচনায় একমত হতে না পারার অর্থ এই নয় যে, আমাদের মধ্যে ঐক্যমত নেই। আমরা মনে করছি, একটা নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ঐক্য আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে।