মিটফোর্ডের সামনে নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া, শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত বিএনপির

Sadek Ali
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৭:২৮ অপরাহ্ন, ১২ জুলাই ২০২৫ | আপডেট: ৩:৫৬ পূর্বাহ্ন, ১৩ জুলাই ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর মেরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা যেমন দেখা যাচ্ছে, আবার বিএনপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

এই ঘটনায় পাঁচ জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে সরকার।

আরও পড়ুন: সাংবাদিক তুহিন হত্যায় জড়িতদের প্রায় সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের কথা জানিয়েছেন সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।

আর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

আরও পড়ুন: ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে সংগ্রহ করা হচ্ছে ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা

নিহত ব্যক্তিকে ব্যবসায়ী ও যুবদল কর্মী আখ্যায়িত করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল আজ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, তারা এ ঘটনায় পাঁচ জনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে।

তবে একই সাথে তারা অভিযোগ করেছে, ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল এমন তিন জনকে আসামি তালিকায় রাখা হয়নি।

এদিকে এ ঘটনার পর বিএনপি ও তারেক রহমানকে জড়িয়ে বা ইঙ্গিত করে সামাজিক মাধ্যমে ‘প্রচার’ চলছে, বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আবার বিভিন্ন জনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মিছিলের স্লোগানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে বিএনপির ভেতরে।

পুলিশ ও র‍্যাব এ ঘটনায় গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় জানিয়েছিলো, ‘প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরে এ ঘটনা সংঘটিত হয়’। যদিও এ ঘটনার পর ‘চাঁদাবাজি’র অভিযোগও আলোচনায় এসেছে।

অন্যদিকে র‍্যাব মহাপরিচালক এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, মিটফোর্ডের ঘটনার মূল তদন্ত ঢাকা মহানগর পুলিশ করলেও তারা শুক্রবার থেকে এর ছায়া তদন্ত শুরু করেছেন।

ওদিকে মিটফোর্ডে ওই হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ নাম ব্যবহার করে যেসব মিছিল হয়েছে সেখান থেকে বিএনপি ও দলটির ভারপ্রাপ্ত তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্লোগানে দেওয়া হয়েছে।

দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলছেন, দল থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের প্রচারণাকে “পরিকল্পিত” ও “নোংরা রাজনীতির চর্চা” বলে তারা মনে করেন।

বিএনপির নেতাকর্মীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে কি না–– এমন প্রশ্নের জবাবে মি. আহমেদ জানিয়েছেন, দলের জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে একটি ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন।

ঘটনা সম্পর্কে কী জানা যাচ্ছে

পুলিশ ও র‍্যাব জানিয়েছে, ঘটনাটি বুধবারের এবং এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে বৃহস্পতিবার।

কিন্তু এর বীভৎসতার দিকটি সামনে আসে শুক্রবার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার মধ্য দিয়ে।

সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (যেটি মিটফোর্ড হাসপাতাল নামেও পরিচিত) একটি গেটের সামনে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে সংঘটিত ঘটনায় যারা জড়িত ছিলেন তারা বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে।

এরপর সংগঠন তিনটি থেকে পাঁচ জনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

ঘটনার যে ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে আছে তাতে দেখা যায়, পিটিয়ে আঘাতের পর ওই ব্যক্তির বিবস্ত্র শরীরে পাথরখণ্ড দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে। এক পর্যায়ে অন্তত দুই জনকে ওই ব্যক্তির শরীরের ওপর উঠে লাফাতে গেছে ভিডিও ফুটেজে ।

নিহত ব্যক্তির বোন মামলার এজাহারে জানিয়েছেন, তার ভাই ঢাকার রজনী বোস লেন এলাকায় অনেক দিন ধরেই ভাঙারি পণ্যের ব্যবসা করতেন। তার সঙ্গে ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মামলার আসামিদের বিরোধ চলছিলো।

আসামিরা ওই ব্যক্তির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের গুদামে তালা দেওয়া ছাড়াও তাকে এলাকাছাড়া করতে বিভিন্ন সময় হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছিলো বলেও এজাহারে বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, বুধবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আসামিরা নিহত ব্যক্তির ভাঙ্গারির দোকান সোহান মেটালে প্রবেশ করেন। তাদের সঙ্গে ধারালো দা, লোহার রড, লাঠিসোঁটা, সিমেন্টের কংক্রিট, পাথরের টুকরো ইত্যাদি ছিল।

“আসামিরা ভাইয়ের কর্মচারীসহ অন্যদের বের করে দিয়ে টানা-হেঁচড়া করে আমার ভাইকে মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নং গেটের ভেতরে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে আমার ভাইকে এলোপাতাড়ি লোহার রড, লাঠি ও সিমেন্টের ব্লক/ইট দ্বারা আঘাত করে গুরুতর জখম করে,” এজাহারে বলা হয়।

ভিডিও ফুটেজে তীব্র প্রতিক্রিয়া

বুধবারের ঘটনার ভিডিও শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার হতে থাকে। রাতে এর প্রতিবাদে মিছিল শুরু হয় বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায়।

এসব মিছিল থেকে বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে নিয়েও সমালোচনামূলক স্লোগানে দেয়া হচ্ছে–– এমন ভিডিও এসেছে সামাজিক মাধ্যমেই।

প্রতিক্রিয়া আসে বিএনপির দিক থেকেও।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান।

শুক্রবার সন্ধ্যায়ই দুজনকে বহিষ্কারের কথা জানায় যুবদল। আরও দুইজনকে বহিষ্কার করে ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল।

বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও যুবদলের এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন মোট পাঁচ জনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করার তথ্য দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না অভিযোগ করেছেন, এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা গেছে তাদের এখনো গ্রেফতার হয়নি। সরাসরি ঘটনায় জড়িত তিনজনকে বাদ দিয়ে পুলিশ নিরপরাধ তিন জনকে আসামি করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

“কারা কেন এ তিনজন আসামিকে বাদ দিয়ে নতুন করে অন্য তিনজনকে আসামি করলো—এটা জানতে চাই। বুধবারের ঘটনা, প্রচার হলো শুক্রবার। দুদিন পর কেন? সেটাও আমাদের প্রশ্ন। সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের সবাইকে গ্রেফতার করা উচিত,” বলছিলেন যুবদল সভাপতি।

তবে র‍্যাবের মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান আজ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড বিষয়ে অভিযান চলমান আছে এবং এর সঙ্গে জড়িত আসামিদের সবাইকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

“এর তদন্ত মূলত ডিএমপি করছে। কারা কীভাবে জড়িত সেটা তারা তদন্ত করে বের করবে। আমরা ছায়া তদন্তের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা করছি। কাল থেকেই এই তদন্ত শুরু করেছি,” বলেছেন তিনি।

বিএনপিতে প্রতিক্রিয়া, শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত

মিটফোর্ডের ঘটনার ভিডিও ব্যাপক প্রচারের পর শুক্রবার রাতে বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তারেক রহমানের নাম উল্লেখ করে যেসব স্লোগানে দেওয়া হয়েছে তাকে পরিকল্পিত মনে করছেন দলটির নেতারা।

কেউ কেউ ফেসবুকেও তারেক রহমানের নাম উল্লেখ করে পোস্ট দিয়েছেন, যা নিয়ে দলের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার আভাস পাওয়া গেছে দলটির নেতাদের সাথে কথা বলে।

এনসিপি নেতা সারজিস আলম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন–– “আপনার দলের নেতাকর্মী নামক কতিপয় নরপিশাচকে সামলান, জনাব তারেক রহমান। যে নিয়মে আওয়ামী লীগের করা হ-ত্যার দায় খু-নী হাসিনার উপর বর্তায়, সেই একই নিয়মে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের করা খু-নের দায় আপনার উপরেও বর্তায়.....।”

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, দায় চাপানোর “নোংরা পুরানো রাজনৈতিক চর্চা’র মাধ্যমে কেউ কেউ ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন” বলে তারা মনে করেন।

“কিন্তু এটাও সত্যি, কিছু ঘটলে সাথে সাথে বিএনপিকে জড়িয়ে প্রচার শুরু হয়। অনেক ঘটনা পরে ভুলও প্রমাণিত হয়,” বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, “খুলনায় যুব দল কর্মীকে হত্যা কিংবা মসজিদে ইমামকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনাগুলো নিয়ে কিন্তু সেভাবে কাউকে কথা বলতে দেখা যায় না।”

প্রসঙ্গত, খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক এক নেতাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যার ঘটনা ঘটেছে শুক্রবার। ওইদিনই চাঁদপুর শহরের প্রফেসরপাড়া মোল্লাবাড়ি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুর রহমানকে জুমার নামাজের পর মসজিদের ভেতরেই কুপিয়ে জখম করা হয়েছে।

তারপরেও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বাড়ছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে মি. আহমেদ বলেন, বিএনপি একটি বিশাল দল এবং এখানে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলেই তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

“দল হিসেবে আমাদের যা ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আছে সেটা আমরা নিচ্ছি। সরকারকেও সহযোগিতা করছি। নিজেরা পুলিশের হাতে দিয়েছি এমন উদাহরণও আছে। দল হিসেবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। সেটি তো করছি। সরকারের দায়িত্ব আইনি ব্যবস্থা নেয়া,” বলছিলেন তিনি।

তিনি জানিয়েছেন দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তাতে জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দেখা হবে কারও ‘রেকর্ড খারাপ’ কি-না। এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অগ্রিম ব্যবস্থা দল থেকে নেয়া যায় কি-না সেটিও পর্যালোচনা করা হবে।

ওদিকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, “মিটফোর্ডের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর। এই ঘটনার সাথে জড়িত ৫ জনকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত শুরু করেছে”।

তিনি লিখেছেন, “এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হবে। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন, ২০০২ এর ধারা ১০ এর অধীনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের ব্যবস্থা করা হবে।”