নিয়মিত সচিবরা এ পদে যেতে অনীহা, নিজেদের লোক বসাতে রাজনৈতিক দলগুলো তৎপর
সচিব নিয়োগে সিদ্ধান্তহীনতায় জনপ্রশাসনে স্থবিরতা

সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়োগে সিদ্ধান্তহীনতায় প্রশাসনে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় এখন নিয়মিত সচিবদের কেউ এ পদে যেতে চাচ্ছে না। কয়েক সপ্তাহ ধরে শূন্য হয়ে থাকা এ পদে নিয়োগের জন্য বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও এনসিপির পক্ষ থেকে নিজেদের লোক বসাতে নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। তদবিরের মুখে সরকার অনেকটাই সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে প্রশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ নিয়ে।
প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়োগ বদলি পদোন্নতি শৃঙ্খলা সার্বিক দায়িত্বে থাকা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে নির্বাচনমুখী প্রশাসন সাজাতে গিয়ে হঠাৎ স্থবিরতায় পড়েছে জনপ্রশাসন সচিবের পদ শূন্য থাকায়। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না এ পদে কাউকে। বছরের শেষ সময়ে এমনিতেই জনপ্রশাসনের পদোন্নতি শৃঙ্খলা নিয়োগ বদলির রুটিন দায়িত্ব থাকে। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি নির্বাচন ঘিরে তফসিলের আগ মুহূর্তে নির্বাচনমুখী জনপ্রশাসন সাজানো হয়। প্রধান উপদেষ্টার এক বৈঠকে এ ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। মোকলেসুর রহমানের বিতর্কিত সময়ে জনপ্রশাসনের কার্যক্রমে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তার বদলিতে জনপ্রশাসন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসলেও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে যেতে অনেকেই ঝুঁকি মনে করছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনে বিএনপি জামায়াত ইসলামী ও এনসিপির বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও আছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নির্বাচনের আগে নিয়োগ দিতে প্রতিটি দল পক্ষই নিজেদের লোক নিয়োগ দিতে তৎপর। বিভাগীয় কমিশনার জেলা প্রশাসক , এডিসি ইউএনও এসিল্যান্ড ম্যাজিস্ট্রেটসহ নির্বাচনে সকল পদেই জনপ্রশাসন নিয়োগ বদলি করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি এর পদে এখন নিয়োগে কেউ আগ্রহী নয়। চাকুরিতে থাকা সচিবরা এর প্রতি একেবারেই যেতে চাচ্ছে না। দলীয় বা কোন পক্ষের প্রভাবে নিয়োগ হলে নির্বাচনের আগে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতি পড়তে হয়। চুক্তিভিত্তিক কাউকে দেওয়া হলে তার অভিজ্ঞতা ও জনপ্রশাসনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। এর জন্য সরকারের মাঝে এ পদে পতিত স্বৈরাচার বিরোধী দক্ষতা সম্পন্ন মোটামুটি নিরপেক্ষ কাউকে নিয়োগ দিতে দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। সরকারের বিশ্বস্ত সূত্র জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর জনপ্রশাসনে প্রথম অতিরিক্ত সচিব এপিডি নিয়োগ পান বর্তমান বর্তমান শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান। তিনি ১৫ তম বিসিএসের কর্মকর্তা। বিগত লীগ সরকারের আমলে বঞ্চিত ছিলেন। মোকলেসুর রহমানের দুর্নীতি বিতর্কিত সময়ও তিনি দক্ষতার সাথে এপিডির দায়িত্ব পালন করেন । জনপ্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ এপিডি উইনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে তাকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। সরকারের সচিবদের মধ্যে তার সততা দক্ষতা ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড প্রশ্নতীত। শেষ মুহূর্তে সরকারের নীতি নির্ধারকরা জনপ্রশাসন সচিব পদে ইতোপূর্বে এপিডির সফল দায়িত্ব পালন করা শিল্প সচিবকে নিয়োগ দিতে পারেন বলে জানা গেছে। শিল্প সচিব ওবায়দুর রহমান সম্পর্কে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও এনসিপির কারো ক্ষেত্রে কোন আপত্তি কখনো ছিল না। জনপ্রশাসন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে কোথাও তার কোন বিতর্কিত ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
আরও পড়ুন: বিচারকদেরও জবাবদিহিতা থাকা উচিত: ট্রাইব্যুনালের অভিমত
ভোটের চার মাস আগে মাঠ প্রশাসনের ব্যস্ততার মধ্যে জনপ্রশাসন সচিবের গুরুত্বপূর্ণ পদটি ফাঁকা রয়েছে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে।
গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নতুন কাউকে দায়িত্ব দিতে সিদ্ধান্তহীনতায় অন্তর্বর্তী সরকার। এক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক তদবির ও পরামর্শের চাপে’র কথাও বলেছেন বর্তমান ও সদ্য সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা। এদিকে জনপ্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও বদলির তদারকিতে গঠিত জনপ্রশাসন বিষয়ক কমিটি সোমবার বিকালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
আরও পড়ুন: রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
কমিটির সভাপতি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানসহ অন্য সদস্যরা ছিলেন। বৈঠকের একপর্যায়ে কমিটিতে থাকা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বাদ রেখে উপদেষ্টারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করেন।
একসময় প্রশাসনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পদগুলোর একটি ছিল জনপ্রশাসন সচিবের আসন। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এটি ছিল শীর্ষ কর্মকর্তাদের স্বপ্নের পদ। কিন্তু এখন সেই ‘হট সিট’ যেন পরিণত হয়েছে ‘কাঁটার সিংহাসনে’। প্রশাসনের তৃতীয় ক্ষমতাধর পদটি নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
নগ্ন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, তদবিরের চাপ, বদলি-পদোন্নতি নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ এবং ব্যক্তিগত ‘ইমেজ সংকট’—সব মিলিয়ে অন্তত সাতজন সচিব এই পদ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। অথচ এক সময় এই পদ পেতে চলত কোটি টাকার দৌড়ঝাঁপ আর অদৃশ্য তদবির।
সরকারের নীতিনির্ধারকদের বিশ্বস্থ সূত্র জানায়, নতুন জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগে আলোচনায় থাকা ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এ এস এম সালেহ আহমেদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী ও অবসরে যাওয়া সিনিয়র সচিব মো. শামসুল আলমের বিষয়ে আলোচান হয়েছে। তাবে তাদের কেউ এপদে যেতে আগ্রহী নন। তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে তা জানিয়ে দিয়েছেন। এছাড়াও নিয়মিত চাকরিরত সচিবদের মধ্যে সিনিয়র প্রবাসী কল্যাণ সচিব নেয়ামত উল্লা ভুইয়া, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিব পান্না ও সিনিয়র সচিব আলেয়া বেগমও জনপ্রশাসন সচিব হতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. এরফানুল হক বলছেন, নতুন জনপ্রশাসন সচিব নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো তথ্য তার কাছে নেই।
তিনি বলেন, “এখনো কোনো ফাইল আমার দপ্তরে আসেনি। ফাইল এলে বুঝতে পারব।”
সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায় গণঅভ্যূত্থানের পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া ড. মোখলেস উর রহমানকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। মাত্র ১৩ মাসের মাথায় তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর মেয়াদকালে সচিব নিয়োগে অনিয়ম, দীর্ঘদিন পদ শূন্য থাকা, ডিসি পদে যুগ্ম সচিবদের বহাল রাখা, কাজের গতি কমে যাওয়া- এসব অভিযোগ প্রশাসনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। দায়িত্ব পালনকালে গণহারে জেলাপ্রশাসক বদলাতে গিয়ে বিপুল ‘আর্থিক লেনদেনের’ অভিযোগে সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়েছেন মোখলেসুর রহমান। যদিও সেসব অভিযোগের ‘বিন্দু বিসর্গেরও সত্যতা নেই’ বলে তিনি দাবি করেছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মোখলেছুর রহমানের সময়ে জনপ্রশাসনে ৭২টি সচিব, ৩৫৮টি অতিরিক্ত সচিব ও সাড়ে চারশ যুগ্ন সচিব পদায়ন করা হয়্। অধিকাংশ দফতরের প্রধান নিয়োগ করা হয়। তম্মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত পদের মধ্যে অভিযোগ হল বিগত সরকারেরর সময়ে চরম সুবিধাভোগী কর্মকার্তাদের বিআরটিসি চেয়ারম্যান, শ্রম ও জনশক্তির প্রধান, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদ গুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৫ জন অন্তত সচিব তার হাতে পোস্টিং পায়।
এদিকে জনপ্রশাসন সচিব হতে না চাওয়ার কারণ নিয়ে কেউ প্রকাশ্যে কথা বলতে চাননি। তবে সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন,“এই মুহূর্তে জনপ্রশাসন সচিব হওয়া মানে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকিতে ফেলা। কেউ বদনাম নিতে চাচ্ছেন না।” প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতিতে কাউকে জোর করে দায়িত্ব দিলেও তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। এতে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে জনপ্রশাসনে। সরকারেরর শুরু থেকেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যান্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্তহীনতা ও রাজনৈতিকদলগুলোকে খুশি করার নীতি প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে বলে অনেকেই মনে করেন।