সিএমপির সাংবাদিক নির্যাতন: ঘুসি আকবরের পর ডিসি আমিরুল

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন আচরণে সাংবাদিকরা পেশাগত কাজে বারবার হামলার শিকার হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলছে। প্রবীণ ফটো সাংবাদিক হাজী জহিরুল হকের ওপর তৎকালীন ডিসি (নর্থ) আলি আকবর খানের বর্বর নির্যাতনের ঘটনা আজও সাংবাদিকদের চোখে পানি আনে। সর্বশেষ সিএমপির ডিসি আমিরুল ইসলাম থানার ভিতরে মারমুখী মূর্তি ধরে যমুনা টিভির সাংবাদিকের ওপর পৈশাচিক কায়দায় নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ সাংবাদিকরা। পাশাপাশি সিএমপি কমিশনারের অপেশাদার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও।
রাজধানী ঢাকার পরই বন্দরনগরী চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা তথা প্রশাসনিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার পদও পুলিশের লোভনীয় একটি পদ। বর্তমান কমিশনার হাসিব আজিজ গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের কমিশনার নিযুক্ত হন ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে। চার মাস আগে অতিরিক্ত আইজিপি পদোন্নতি পেলেও এখনো তদবির করে তিনি ডিআইজি পদেই আঁকড়ে আছেন।
আরও পড়ুন: ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবন সাময়িকভাবে কারাগার ঘোষণা
তার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। পেশাদার সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, অসহযোগিতা ও সেবা প্রার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত দুর্ব্যবহারের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও, এমনকি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও, কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি হাসিব আজিজের।
জনগণ এখন পুলিশের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্ব্যবহার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নারী কর্মকর্তার সঙ্গে অনৈতিক আচরণের অভিযোগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দুই দফা অন্যত্র বদলি করলেও কমিশনারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ডিসি আমিরুলের আচরণে।
আরও পড়ুন: কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঘোষণা
জানা গেছে, সিএমপি উপ-পুলিশ কমিশনার আমিরুল ইসলাম উত্তর বিভাগের দায়িত্বে আছেন। পুলিশের ২৮তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের শুরুর দিকে, ২০১০ সালে।
এদিকে শুধু বর্তমান পরিস্থিতি নয়, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের আচরণের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি ৫ আগস্টের পরও। ২০০৬ সালের ১৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্টেডিয়ামে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আলী আকবর খানের নেতৃত্বে প্রবীণ সাংবাদিক হাজী জহিরুল হকের উপর পৈশাচিক হামলা চালানো হয়। সে সময় ওই ছবিটি ব্যাপক প্রচারিত হলে নিন্দার ঝড় ওঠে এবং ডিসি আকবরকে প্রত্যাহার করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আলোচিত তৎকালীন উপ-পুলিশ কমিশনার আলী আকবর খান বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি হয়েও সিআইডির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ, মানিলন্ডারিং ও অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। তার অনৈতিক আচরণের বিচার না হওয়ায় সিএমপির কর্মকর্তাদের মধ্যে দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানায় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যমুনা টিভির স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জোবায়ে ইবনে শাহাদাত ও ক্যামেরাপার্সন আসাদুজ্জামান লিমনের ওপর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আমিরুল ইসলামের বর্বর হামলার তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন (সিইউজে)।
গত রোববার (১২ অক্টোবর) সকালে নগরীর খুলশী থানায় সংবাদ সংগ্রহের সময় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর বিভাগের ডিসি আমিরুল ইসলাম থানার একটি কক্ষে সাংবাদিক জোবায়েদকে আটকে রেখে নির্মমভাবে কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে আহত করেন। হামলায় তার চোখ, মুখ ও কানে গুরুতর আঘাত লাগে।
রোববার (১২ অক্টোবর) সিইউজে সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন,
“উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচরণ ঘৃণ্য, নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। এটি সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতায় সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর আঘাত।”
বিবৃতিতে হামলাকারী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার ও ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। সাংবাদিক আসাদুজ্জামান লিমন ও জোবায়ে ইবনে শাহাদাতের দ্রুত সুস্থতা কামনা করা হয়েছে বিবৃতিতে।
সিইউজে নেতৃবৃন্দ বলেন, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনের মূলে থাকে পুলিশ। সেই পুলিশেরই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমিরুল ইসলামের সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এই ঘটনায় যদি দৃষ্টান্তমূলকভাবে বিচার না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ আরও সংকুচিত হবে। সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা বলতে আর কিছুই থাকবে না।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, অবিলম্বে এই ঘটনার বিচার হতে হবে। অন্যথায় সিইউজেসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের সাংবাদিক সমাজ কঠোর কর্মসূচি পালন করবে।
দুই সাংবাদিকের উপর ডিসির হামলার প্রতিবাদে খুলশী থানার সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। সমাবেশে অবিলম্বে ডিসিকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে তার বিরুদ্ধে আইনি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তারা।
এতে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ, যুগ্ম সম্পাদক ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার এবং চট্টগ্রাম টিভি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক হোসাইন জিয়া।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক লতিফা আনসারি রুনা, সিইউজের টিভি ইউনিটের প্রধান তৌহিদুল আলম, চট্টগ্রাম টিভি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব একে আজাদ, চট্টগ্রাম টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক আশরাফুল আলম মামুন, যমুনা টিভির ব্যুরো প্রধান জামশেদ রেহমান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির ব্যুরো প্রধান আলমগীর সবুজ, স্টার টিভির ব্যুরো প্রধান এমদাদুল হক ও জাগো নিউজের ব্যুরো প্রধান ইকবাল হোসেন।
গত ১২ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে আয়োজিত একটি কনসার্ট ঘিরে সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের খবর সংগ্রহের সময় ওই ঘটনা ঘটে। তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে খুলশী থানায় যান সাংবাদিক জোবায়েদ, যেখানে তিনি ওই ঘটনায় আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
জানা যায়, গত শনিবার রাতে নগরের জিইসি কনভেনশন সেন্টারে কনসার্টে ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ হাসিনা’ স্লোগান দেওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। থানায় এ ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে যান সাংবাদিক জোবায়েদ। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তার রোষানলে পড়েন তিনি।
থানার কয়েকজন কর্মকর্তা এতে বাধা দেন এবং তাদের সঙ্গে কথাকাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন জোবায়েদ। এরপরই তাকে থানার সেকেন্ড অফিসারের কক্ষে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
জোবায়েদ বলেন, “আমি চলে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারতে থাকে পুলিশ সদস্যরা। তারা বলে, ‘তুই ফ্যাসিস্ট, আমরা তোকে মারছি না, শয়তানকে মারছি।’”
জোবায়েদ আরও জানান, হামলার সময় পিঠে লাথি ও কনুই দিয়ে একাধিকবার আঘাত করা হয় তাকে। এতে তার চোখ ও এক কানে গুরুতর আঘাত লাগে।
হামলার নেতৃত্ব কার হাতে ছিল জানতে চাইলে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “সিএমপির ডিসি আমিরুল ইসলাম।”
এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন। তারা ঘটনার দ্রুত তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবি তুলেছে।
অপরাধ বিশ্লেষক এনামুল কবীর রূপম বাংলাবাজার পত্রিকাকে বলেন, “সাংবাদিক-পুলিশ সম্পর্ক এ অবস্থায় চলতে থাকলে তার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে সব জায়গায়।”
এই ঘটনার দুই দিনেও সমাধান কিংবা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার উদ্যোগহীনতা সেই আশঙ্কাকেই বাস্তবে রূপ দিচ্ছে।