গণভোটের জটিলতা: ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়ছে
বাংলাদেশে সংবিধান সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে যে গণভোট আয়োজনের ঘোষণা এসেছে, তা নিয়ে এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার ১৩ নভেম্বরের ভাষণে গণভোটের প্রশ্ন ও কাঠামো পরিষ্কার হলেও ভোটারদের বড় অংশ বিষয়গুলো বুঝতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কারণ, চারটি বৃহৎ সাংবিধানিক ইস্যুকে একত্রে রেখে একটি মাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মতামত দিতে হবে। ফলে অনেক ভোটার বিভ্রান্ত—কোনো বিষয়ে সমর্থন থাকলেও অন্য বিষয়ে আপত্তি থাকলে তারা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আরও পড়ুন: লাভেলো আইসক্রিমের এমডি-চেয়ারম্যানসহ চারজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
গৃহিণী মমতা চৌধুরী বিবিসিকে জানান, গণভোটের বিষয় শুনেছেন কিন্তু বুঝতে পারেননি। তিনি বলেন, “উনারা যেভাবে বলতেসেন এগুলা কিছু তো বুঝি না। এত প্যাচায়ে কথা বলেন—বুঝি না।”
তবে ‘সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি’ বিষয়টিতে তার আগ্রহ রয়েছে।
আরও পড়ুন: যারা ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তাদের কাছে দেশ নিরাপদ নয় : সালাম আজাদ
বুয়েট শিক্ষার্থী মুশফিকের মতে, প্রস্তাবিত চারটি বিষয়ই যৌক্তিক এবং এগুলো সংস্কারের পথে বড় পদক্ষেপ।
অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিজীবী মরিয়ম আক্তার প্রশ্ন তুলেছেন—“আমি যদি দুইটায় হ্যাঁ মনে করি আর দুইটায় না, তখন কী করবো?”
চারটি মূল বিষয় এক নজরে
১. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান—জুলাই সনদ অনুযায়ী পুনর্গঠন।
২. দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ—১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ; সংবিধান সংশোধনে এর সম্মতি বাধ্যতামূলক।
৩. ৩০ দফা সংস্কার বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক—নারীর আসন বৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদসীমা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়।
৪. অন্যান্য সংস্কার—জুলাই সনদের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: বিএনপি ও জামায়াতের অসন্তোষ
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা আসার পর বিএনপি প্রথমেই অভিযোগ তোলে যে তিনি “মূল দলিল থেকে সরে গেছেন”। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাস্তবায়ন আদেশ ও সাক্ষরিত জুলাই সনদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, কিছু অংশ “বিতর্কিত”।
তবে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে করার সিদ্ধান্তকে বিএনপি শেষ পর্যন্ত স্বাগত জানায়।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি দাবি করেছে, গণভোট আলাদা দিনে হলে ভালো হতো। জামায়াতের মতে, চারটি বিষয়কে একত্রে জিজ্ঞাসা করলে জনগণ বিভ্রান্ত হবে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
এনসিপির অভিযোগ—সংস্কারের সব বিষয় সমান গুরুত্ব পায়নি। কিছু বিষয়কে রাজনৈতিক দলের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ মত: প্রচারণা ছাড়া গণভোট ব্যর্থ হতে পারে
সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, প্রশ্নগুলো অত্যন্ত জটিল। সরকারের পক্ষ থেকে শক্তিশালী জনসচেতনতামূলক প্রচারণা না হলে ভোটাররা গণভোটের ব্যালট ফাঁকা রেখে দিতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে জুলাই সনদের কিছু বিষয় সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, একদিকে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ, অন্যদিকে প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষ—একই কাঠামোয় দুটো রাখা সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমদের মতে, চারটি বিষয়কে এক প্রশ্নে যুক্ত করা জনগণের মতামতের পরিসর সংকুচিত করেছে।
আগামীর চ্যালেঞ্জ: গণভোটে ‘না’ এলে কি হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণভোটে ‘না’ ভোট হলে পুরো সংস্কার প্রক্রিয়া ভেঙে পড়বে এবং বর্তমান সংবিধানই বহাল থাকবে। এর ফলে নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক মতবিরোধ আরও তীব্র হতে পারে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এখনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসেনি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা





