নির্বাচন বানচালে সক্রিয় ফ্যাসিবাদী শক্তি

- রাজনৈতিক নেতাদের উপরগুপ্ত হামলা
- শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা
- শ্রমিকদের আন্দোলনের চেষ্টা
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পলাতক ফ্যাসিবাদী শক্তি। এর কিছু আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হচ্ছে। এরমধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের উপর হামলা, শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা তৈরি, শ্রমিক অসন্তোষের ষড়যন্ত্র দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছে। আর কিছুদিন পর দেশে শুরু হবে হিন্দুদের দুর্গাপূজা। ওই পুজাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অঘটন ঘটানোরও ষড়যন্ত্র চলছে বলে গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে। ছাত্র- জনতার অভ্যুত্থানে ভারতে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও এদেশে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী লীগ
ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতি সুকৌশলে এ ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে আশার বিষয় হচ্ছে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিজেও এ
আরও পড়ুন: গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিলম্বের কারণে দেশে সংকট প্রকট হচ্ছে: আমীর খসরু
বিষয়টি বেশ ভালভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি গত ২ সেপ্টেম্বর সাতটি রাজনৈতিক দল ও একটি সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচালের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যত রকমভাবে পারে বাধা দেবে। বাংলাদেশের সত্ত্বাকে গড়ে তুলতে তারা বাধা দেবে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করার। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার, যাতে নির্বাচন না হয়। এগুলোর কিছু কিছু লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে। সামনে আরও আসবে। এ জন্য আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে। আমাদের চেষ্টা হবে নির্বাচন নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের। তিনি বলেন, প্রতি পদে পদে বাধা আসবে, সবার মনে দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করবে। আমরা যেন সঠিক থাকি, স্থির থাকি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবার সহযোগিতা দরকার।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সামনের দুর্গাপূজায় আমাদের সবার দায়িত্ব হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। অনেকে গণ্ডগোল তৈরি করতে চাইবে। তারা সব রকমের চেষ্টা করবে। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে । বিতাড়িত ফ্যাসিবাদী শক্তি শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা তৈরির প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আলামত দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও পলিটেকনিক কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা চলছে। শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি হলে এর নেতিবাচক প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে অবশ্যই পড়বে। শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতার প্রভাবে দেশে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে পারে এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর প্রভাব অতীতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হতে পারে মন্তব্য করে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মুহূর্তে জাতীয় রাজনীতির বীজটা ছাত্রদের মুভমেন্ট থেকে আসা।
আরও পড়ুন: মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি বিএনপির নজরুল ইসলাম খান
বিবিসি বাংলা'র বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চলতি সপ্তাহে ঢাকায় দুইটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘিরে রাজনীতিতে অস্থিরতার মধ্যে হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। আলাদা আলাদা ইস্যুকে কেন্দ্র করে ৩১ আগস্ট তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা ও সংঘর্ষের পর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। দেশের বর্তমান অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো অশান্ত হয়ে যাওয়ার বিষয়কে একেবারেই বিচ্ছিন্ন মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ-উর-রহমান বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসগুলোর অস্থিতিশীলতার প্রভাব আগে যেভাবে জাতীয় রাজ- নীতিতে পড়তো, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পড়বে। বিশেষ করে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে নানা আলোচনা চলছে। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও বিভেদও তৈরি হয়েছে, প্রায় একই সময়ে ক্যাম্পাসগুলোয় টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর বাইরে রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপর গুপ্ত হামলা শুরু হয়েছে। এটি খুবই অশনি সঙ্কেত।
সব মিলিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই বিষয়গুলোকে একেবারে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা মনে করার কোন সুযোগ নেই। ভারতে পালিয়ে থাকা পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে নানান ষড়যন্ত্র করছেন। তাকে নানাভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে ভারত। কাছেই সব বিষয় বিবেচনায় রেখেই সরকারকে আগামী নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলেন, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যে কারণে ছাত্রদের ক্ষমতা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশি। ছাত্ররাই প্রভাবিত করতে পারে রাজনীতিকে। এর প্রভাব আগে যেভাবে রাজনীতিতে পড়তো, তারচেয়ে এখন অনেক বেশি পড়বে। কারণ এই মুহুর্তে জাতীয় রাজনীতির বীজটা ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্রদের মুভমেন্ট থেকে আসা। ফলে এই প্রভাবটা প্রচণ্ডভাবে জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে। যার ফলাফল খুব ভাল কিছু হবে না। ডাকসু-রাকসু বা চাকসু নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা আছে।
এখানে পুরো বিষয়গুলোও কাজ করছে। বিষয়গুলো আলাদাভাবে দেখার কোন সুযোগ নাই। বিচ্ছিন্ন ভাবার কোন কারণ নাই। চলমান এই সংকট যদি শিগগিরই দূর করা না যায় তাহলে ক্যাম্পাস রাজনীতির প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে খুব বড় আকারে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুধু শিক্ষাঙ্গনই নয়, দেশের বিভিন্ন শিল্প-কলকারখানায়ও শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে অস্থির পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে গত ২ সেপ্টেম্বর নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিক আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিয়েছে।
২৩ দফা দাবিতে গত ৩০ অক্টোবর থেকে এভারগ্রীন কোম্পানির শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলে তা ধীরে ধীরে অন্য কারখানার শ্রমিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। গত ২ সেপ্টেম্বর আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে যৌথবাহিনী মাঠে নামলে সংঘর্ষ বাধে। এতে হাবিবুর রহমান হাবিব নামে এক শ্রমিক নিহত হন, আহত হন অন্তত ১৫ জন। পরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাবের যৌথ উদ্যোগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনার পর ইপিজেডের সব কারখানা এখন বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে বেতন-ভাতার দাবিতে গতকাল রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকরা রাজপথ অবরোধ করে আন্দোলন করে। এ ছাড়া একদল শ্রমিক জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনেও মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে। সব মিলিয়ে দেশের বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও গার্মেন্টস শ্রমিকদেরও উস্কে দিয়ে তাদের মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী লীগ, যুব লীগ ও ছাত্র লীগের সন্ত্রাসীরা।
অন্যদিকে, আগামী নির্বাচনের আগেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটানোর জন্য পতিত আওয়ামী লীগ বিভিন্ন দলের নেতাদের উপর গুপ্ত হামলারও টার্গেট নিয়েছে। ইতোমধ্যে গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে সন্ত্রাসীরা পল্টনে জাগপার সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমানের উপর হামলা করে। পল্টনে গণঅধিকার পরিষদ অফিসে রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের বৈঠক শেষে বের হয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় কয়েকজন সন্ত্রাসী এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করেছে। এর আগে গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের সমাবেশে হামলা করা হয়। সেখানে নুরের উপরও ব্যাপক হামলা চালিয়ে তাকে গুরুতর আহত করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এসব ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে করছেন। তারা বলছেন নির্বাচনের আগে অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য ফ্যাসিবাদী শক্তি টার্গেট করে রাজনৈতিক নেতাদের উপর এ ধরনের হামলা করতে পারে। আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সংগঠন জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)'র সভাপতি খন্দকার লুৎফর রহমানের ওপর সন্ত্রসীদের হামলা খুবই উদ্বেগজনক। এ ধরনের বর্বরোচিত হামলা একটি গভীর চক্রান্তের অংশ। আমরা মনে করি, আগামী জাতীয় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবেই এ হামলা সংঘটিত হয়েছে। সরকারের দায়িত্ব অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।