বর্ষায় বন্যা আতঙ্কে বাসিন্দারা

দখল-দূষণ ও অবৈধ বাঁধে মৃত লক্ষ্মীপুরের ভুলুয়া নদী

Sadek Ali
জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ৮:৫২ অপরাহ্ন, ৩১ মে ২০২৫ | আপডেট: ১১:১৭ অপরাহ্ন, ০৯ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগর উপজেলার খরস্রোতা ভুলুয়া নদী, এখন প্রায় মৃত। নাব্য সংকট ও অবৈধ দখল আর প্রভাবশালীদের বাঁধের কারণে পলি জমে কমে গেছে নদীর প্রশস্ততা। ফলে ২০২৪ এর ভয়াবহ বন্যার প্রধান কারণ ছিল এই নদীটি। এখন বর্ষার মৌসুম চলে আসায় আবারও বন্যার আতঙ্কে ভুলুয়া নদী তীরবর্তী বাসিন্দারা। অপরদিকে দীর্ঘ বছর ধরে খনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি শুকিয়ে যায়। এতে ব্যহত হচ্ছে চাষাবাদ।

জানা যায়, নোয়াখালীর সূবর্ণচর ও বেগমগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর এবং রামগতি উপজেলার ওপর দিয়ে মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে খরস্রোতা ভুলুয়া নদী। এ নদীর দৈঘ্য ছিল ৭৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ছিল ৫০০ মিটার। দখল, অবৈধ বাঁধ নির্মাণ আর পলি জমে নদীর প্রস্থ এখন দাঁড়িয়েছে ৮৫ মিটারে। নদীটি খনন না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে হেঁটেই পার হওয়া যায়। পানির অভাবে হুমকির মুখে মাছসহ নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র। এর ফলে কমে গেছে আশেপাশের কৃষি উৎপাদনও।

আরও পড়ুন: ভোলায় শুল্ক ফাঁকি দেওয়া অবৈধ সিগারেটসহ আটক ৩

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে ভুলুয়ার কারণে বন্যায় ডুবেছে দুই উপজেলা লক্ষাধিক মানুষ, সে ভুলুয়াতে এখন হাটুপানিও নেই। বৈশাখের বৃষ্টির আগেও ভুলুয়ার বিভিন্ন স্থান শুকিয়ে চৌচির হয়ে ছিল। এখনকার ভুলুয়া দেখে বোঝার উপায় নেই, কয়েক মাস আগেও রাক্ষসী রুপে আর্বিভূত হয়ে ঘরবাড়ি, ফসলি মাঠ ভাসিয়েছে নদীটি। ভুলুয়া মৃত হওয়ার পেছনে দায়ি করা হচ্ছে স্থানীয়দের দখল, আর মাছ শিকারের বাঁধকে। আর দীর্ঘ সময় ধরে ভুলুয়ার দখলদারিত্ব নিয়ে কিংবা পুনঃখননে নেওয়া হয়নি কার্যকর কোন প্রদক্ষেপ। এ সুযোগে এ নদীকে ‘গলাটিপে’ যেন হত্যা করা হয়েছে। তবে ভুলুয়ার এমন করুণ দশার কারণে একদিকে যেমন বন্যার কবলে পড়ছে বাসিন্দারা, অন্যদিকে কৃষি উৎপাদন থেকে বাদ যাচ্ছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি। পরিকল্পিত খননে ভুলুয়ায় ফিরতে পারে প্রাণ, বর্ষায় বাসিন্দারা রক্ষা পাবে বন্যা থেকে। ভুলুয়ার পানি দিয়ে অনাবাদি জমিতে সোনালী ফসল ফলাতে পারবে কৃষকেরা। এমনটাই মনে করছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ এবং নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দারা।

স্থানীয় বাসিন্দা চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রামের নাসির আহমেদ, আবুল খায়ের, ইয়াসিন ও মন্তাজ মিয়া বলেন, গেল বর্ষা মৌসুমে যখন বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে, ঠিক তখনই ভুলুয়া পুনরুদ্ধার এবং খননের জন্য আন্দোলন শুরু করে আব্দুস সাত্তার পলোয়ান নামে সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। এ লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। বন্যাকালীন নিজেই ভুলুয়াতে নেমে পড়েন বাঁধ ও মাছ শিকারে পেতে রাখা অবৈধ বাঁধ ও জাল অপসারণে। গেলবারের ভয়াবহ বন্যায় ভুলুয়ার সংকট যখন সামনে চলে আসে, তখন নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু বন্যার অতিরিক্ত পানির কারণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। দ্রুত অবৈধ বাঁধ ও প্রভাবশালীদের থেকে জবরদখল মুক্ত করার দাবি জানান ওইসব এলাকার বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন: ভারতীয় চোরাচালান ধরতে গিয়ে নৌকা ডুবে বিজিবি সদস্য নিখোঁজ

স্থানীয়রা জানান, ভুলুয়া নদীর বেশিরভাগ অংশ জুড়েই মৎস্য শিকারীদের অবৈধ বাঁধ। এতে নদীর মাঝ অংশ সংকুচিত হয়ে আছে। বাঁধের কারণে নদীর বিভিন্ন অংশে চর জেগেছে। ভুলুয়ার রামগতি অংশের আজাদনগর ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় দুইপাশ দখল করে বসতি স্থাপন করেছে দখলদাররা। নদীর ভেতর ভরাট করে মৎস্য খামার (পুকুর) কিংবা বাগান তৈরি করছে অনেকে। অপরিকল্পিত ভাবে ইটভাটার জন্য মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে, যার ফলে কোথাও উঁচু আবার কোথাও নীচু। নদীটির কমলনগর এবং রামগতি অংশে ছোটবড় অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এসব ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। বন্যার সময় পরিদর্শন করে দেখা গেছে, নীচু কালভার্টের কারণে বন্যার পানি প্রবাহে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ঠিকমতো পানি নামতে না পারায় অতিরিক্ত পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। গেলো বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে ভয়াবহ বন্যার কবলে ছিল ভুলুয়ার রামগতি ও কমলনগর উপজেলার বাসিন্দারা। ফেনীতে যখন উজানের পানি চাপ দেয়, সেই পানি নোয়াখালীর উপর দিয়ে ভুলুয়া নদী হয়ে রামগতির মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নদীর তলদেশ ভরাট, অবৈধ দখল, মাছ ধরার বাঁধ-জাল, নীচু ব্রিজের রেলিংয়ের কারণে পানি প্রবাহ বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে পানি মেঘনায় প্রবাহিত না হয়ে নদীর দুইকূলের লোকালয়ে প্লাবিত হয়েছে। এতে ডুবেছে বসতবাড়ি, মৎস্য খামার, আর ফসলি জমি। কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ইউনিয়নের একাংশ, চরকাদিরা ইউনিয়নের পূর্ব অংশ, রামগতি উপজেলার চরবাদাম ইউনিয়নের পূর্ব চরসীতা, চর আলগী, চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল ছিল বন্যা কবলিত। এক থেকে দেড় মাস, কোথাও আবার দুই পর্যন্ত পানিবন্দি ছিল লাখ লাখ মানুষ। দীর্ঘ মেয়াদি বন্যার কবলে পড়ায় দুর্গতদের মধ্যে হাহাকার লক্ষ্য করা গেছে। বন্যায় ফসলের যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমন ক্ষতি হয়েছে বসতঘরের। ভেসে গেছে পুকুর-জলাশয়ের মাছ। গবাদিপশু নিয়েও দুর্ভোগে ছিল গৃহস্তরা। ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষিতেও। কৃষকরা জানিয়েছেন, বন্যা যখন শুরু হয়, তখন ক্ষেতে আমনের বীজতলা ছিল, আবার কোন কোন ক্ষেতে সদ্য আমনের চারা লাগানো ছিল। বিভিন্ন শাকসবজির আবাদও ছিল জমিতে। বন্যার পানিতে সবি তলিয়ে যায়। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান খান বলেন, বিগত কয়েক দশক ধরে নদীর তলদেশে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি জমা হয়ে ভরাট হয়ে গেছে। এতে নদীর পানি পরিবহন হ্রাস পেয়ে নাব্যতা হারিয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন, জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সুবিধা গুরুতরভাবে ধস নেমেছে। দীর্ঘ সময় নদী ড্রেজিং বা খনন না করায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে সেচ কাজের জন্য পানির অপ্রাপ্যতা ও বর্ষা মৌসুমে পোল্ডার অভ্যন্তরীণ নীচু এলাকার পানি নিষ্কাশনে অপ্রাচুর্যতা সৃষ্টি হয়। পুনঃখনন না করায় নদীতে অবৈধ দখল ও দূষণের ফলে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে ভরাট হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ভুলুয়ার পুনঃখননের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে মিষ্টি পানি ধরে রাখার মাধ্যমে এ ৫ টি উপজেলার প্রায় ৫২৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সেচ সুবিধায় আসবে। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং আত্ম সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।

তিনি আরও বলেন, ভুলুয়া খনন হলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক হবে। বর্ষা মৌসুমে উপরের পানি নদীতে গিয়ে পড়বে। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি ভুলুয়াতে ঢুকবে। এতে একদিকে যেমন বন্যা বা জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে কৃষিকাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। নানামূখী উপকৃত হবে স্থানীয় বাসিন্দারা।