না ফেরার দেশে বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার

না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন বিশিষ্ট সমাজচিন্তক, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক যতীন সরকার। এলাকা জুড়ে শোকের ছায়া। বুধবার (১৩ আগস্ট) দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। তিনি স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে ও নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য ভক্ত-গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বিকেলে নেত্রকোনা জেলা শহরের সাতপাই এলাকায় যতীন সরকারের 'বানপ্রস্থ' নামক বাসভবনে গেলে দেখায় যায়, পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের ভিড়।
আরও পড়ুন: সাদা পাথর রক্ষায় প্রশাসনের ৫ দফা সিদ্ধান্ত
এ সময় কথা হয় যতীন সরকারের স্ত্রী কানন আইচ, ছোট ভাই অধ্যাপক মতীন্দ্র সরকারসহ কয়েকজন ভক্ত ও গুণগ্রাহীর সাথে।
আপনজন হারিয়ে যতীন সরকারের স্ত্রী কানন আইচ এবং ছোট ভাই মতীন্দ্র সরকার যেন বাকরুদ্ধ। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, তিনি দীর্ঘদিন যাবত শয্যাশায়ী ছিলেন। একদিন হঠাৎ পড়ে গিয়ে পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তারপর ঢাকায় নিয়ে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা করানো হয়। একপর্যায়ে কিছুটা সুস্থ হলে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়।
আরও পড়ুন: পাবনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার
সম্প্রতি তাঁর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানেই তিনি মারা যান।
যতীন সরকারের ভক্ত লেখক স্বপন পাল বলেন, স্যার আমাদের মাঝে নেই, এটা ভাবতেই পারছি না। স্যারকে নিয়ে কি বলব। সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্যারের মরদেহ ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনায় নিয়ে আসা হবে। রাত ৮টার দিকে নেত্রকোনা জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে এবং রাত ১১টার দিকে নেত্রকোনা পৌরশহরের মহাশ্মশানঘাটে স্যারের সৎকার সম্পন্ন হবে।
যতীন সরকার ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের চন্দপাড়া গ্রামে। তাঁর পিতা জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার এবং মা বিমলা বালা সরকার। যতীন সরকারের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু হয় রামপুর ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫৪ সালে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। টিউশনি করে টাকা জমিয়ে ১৯৫৫ সালে আইএ ভর্তি হন নেত্রকোনা কলেজে। এ সময় নেত্রকোনা শহরে তিনি লজিং থাকতেন। এ সময় নেত্রকোনা কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। আইএ পাসের পর ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দিয়েই জীবিকার তাগিদে শিক্ষকতা শুরু করেন নেত্রকোনার আশুজিয়া হাইস্কুলে। এরপর তিনি শিক্ষকতা করেন বারহাট্টা সিকেপি পাইলট হাই স্কুলে। ১৯৬১ সালে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়নের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এমএ পাস করেন তিনি ১৯৬৩ সালে। এ বছরই তিনি যোগ দেন ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাই স্কুলে বাংলার মাস্টার হিসেবে। পরবর্তী বছর ১৯৬৪ সালে তিনি ময়মনসিংহ শহরের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিষয়ের লেকচারার পদে চাকুরি লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে কানন আইচের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। যতীন সরকার এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জনক ছিলেন।
১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে যতীন সরকার ময়মনসিংহের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তাঁর উপস্থিতি শহরে প্রতিটি সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক প্রোগ্রামে অনিবার্য ছিল। তিনি উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল ধরে ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাবের সদস্য ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র নামে একটি পত্রিকা শুরু করেছিলেন।
তিনি সর্বদা মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক নিপীড়ন, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিহত করার জন্য কথা বলেছেন। ২০০৬ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি জাতীয় নির্বাচন নীতি ও ময়মনসিংহের নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আঞ্চলিক সংলাপের সভাপতিত্ব করেন। ২০০৬ সালে বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ডে পালন করে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন, সভাপতিত্বকালে তিনি বলেন, এখন সবকিছুই টাকা দিয়ে করা হয় এবং ফলস্বরূপ, সংবাদপত্রের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণের পর থেকে প্রেসের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এত কঠিন। কর্পোরেশন এবং ব্যবসা চুম্বক যারা পুঁজিবাদের পক্ষে কাজ করে এবং পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বায়নের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। অবশ্যই মিডিয়া এবং উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু সমাজ থেকে দুর্নীতি, অবিচার, বৈষম্য ইত্যাদি দূর না হওয়া পর্যন্ত দারিদ্র্য কমিয়ে আনা যাবে না। তিনি সকলকে স্বাধীনতা অর্জনের আহ্বান জানান এবং ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। তিনিও মনে করেন সংসদ সদস্যগণ আইন ছাড়া অন্য কার্যক্রম জড়িত হওয়া উচিত নয়।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ময়মনসিংহেই তাঁর পরিচিতি ছিল। উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব ও নিভৃতচারী মনোভাবই ছিল মূলত তাঁর জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধক। তারপর থেকে তিনি একজন চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদী এবং নিবেদিতপ্রাণ প্রাবন্ধিক হিসাবে জাতীয় গুরুত্ব অর্জন করতে শুরু করেন। তিনি ক্রমবর্ধমান বিবেকের একটি স্বর হিসাবে স্বীকৃত ।
তিনি গবেষণা ও প্রবন্ধের জন্য ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। এর আগে বাংলা একাডেমি তাকে "ডাক্তার মোহাম্মদ এনামুল হক স্বর্ণ পদক" প্রদান করেছিল। ২০০৬ সালে তিনি 'পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু-দর্শন' শিরোনামের বইয়ের জন্য 'প্রথম আলো বর্ষসেরা বই' পুরস্কার পান। তাঁর প্রাপ্ত অন্যান্য পুরস্কারগুলো হল, নারায়ণগঞ্জ শ্রুতি স্বর্ণপদক, ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব লিটারারি অ্যাওয়ার্ড, খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার এবং মনিরুদ্দিন ইউসুফ সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড।
যতীন সরকারের প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে 'পাকিস্তানের জন্ম মৃতু-দর্শন' একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। এছাড়া বাংলাদেশের কাবি গান, সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা, বাঙালি সমাজতন্ত্র ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, মানব মন, মানব স্বপ্ন এবং সমাজ বিপ্লব, আমাদের সাংস্কৃতিক দিগ্দিগন্ত, সিরাজউদ্দিন কাশিমপুরী, গল্পে গল্পে ব্যাকরণ, জালাল গীতিকা সমগ্র উল্লেখযোগ্য।