সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে আশা নিরাশা

দেশকে গণতন্ত্রের পথে যাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নির্বাচন। প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বোধের জায়গায় সেটা একেবারেই স্পষ্ট। অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচন ও সংস্কার এই দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপও (রূপরেখা) পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন। জাতিকে তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে।
তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না দেওয়ায় আশাহত হয়েছে বিএনপি। মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৮ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ১০০ দিনের পূর্তিতে একটা ভাষণ দিয়েছেন। অনেকে আশান্বিত হলেও আমরা আশাহত হয়েছি। আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সব প্রজ্ঞা দিয়ে সমস্যাটা চিহ্নিত করে নির্বাচনের জন্য একটা রূপরেখা দেবেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন দিলে আমাদের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাই বার বার নির্বাচনের কথা বলছি। বিএনপি ক্ষমতায় যাক না যাক, সেটা বিষয় নয়। আজকে যারা বাংলাদেশের ক্ষতি করতে চায়। স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাচ্ছে। দেশকে সংঘাতের দিকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। নির্বাচনের একটা রূপরেখা দিলে তারা পিছিয়ে যেতে বাধ্য হবে। যত দ্রুত নির্বাচন হবে, তা দেশের জন্য, জাতির জন্য মঙ্গল। অভিজ্ঞতা থেকে এমনটা চাইছেন বলেও জানান তিনি। । এ ধরনের সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকে, তত সমস্যা তৈরি হয়। কারণ, এদের তো ম্যান্ডেট নেই, এরা তো নির্বাচিত সরকার নয়। এই সরকারকে চিন্তা করতে হবে, তারা যত দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচন দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারে, ততই মঙ্গল। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী নির্বাচন নিয়ে সরকারের সময়ক্ষেপণে ঘাপলা দেখছেন। তিনি বলেন, যৌক্তিক সময়ে সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দিতে হবে। তা না হলে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে আশাহত হওয়ার মত কিছু নেই। তিনি তার ভাষণে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করলেও একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন, নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে এটা আর থামবেনা।
জাতির উদ্দেশে তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন, তা ইতিবাচক বলে অভিহিত করেছেন পর্যবেক্ষকরা। প্রধান উপদেষ্টা ১০০ দিনে তার সরকার কী কী কাজ করেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ উল্লেখ করেছেন। জনগণের প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসার দিকগুলোও তার ভাষণে উঠে এসেছে। অনেকে ভাষণকে সরকারের সাফল্য গাঁথা বলে মনে করতে পারেন; তবে সাফল্যের বিবরণও থাকা জরুরি। ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী বিপ্লবেরর মধ্য দিয়ে এই সরকারের প্রতিষ্ঠা, যখন দেশে কোনো সরকার ছিল না। ফ্যাসিস্ট সরকার পালিয়ে গিয়েছিল এবং দেশ ও জনগণ সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল। পতিত ও বিতাড়িত সরকারের দুঃশাসনে দেশের প্রায় সব কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে দেশ পুনরুদ্ধার ও সচল করার দায়িত্ব পড়ে এ সরকারের ওপর। সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। ফলাফল এখন পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে সন্তোষজনক। অনেক ক্ষেত্রে হতাশাজনক। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে সাফল্যের কথা যতটা বলা হয়েছে, ব্যর্থতা ও অপরাগতার কথা ততটা বলা হয়নি। জনজিজ্ঞাসার বিষয়গুলো অনেকের মতে, আরো সুনির্দিষ্ট ও স্পষ্ট হলে ভালো হতো। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। তবে কবে নাগাদ সংস্কার সম্পন্ন হবে এবং কবে নির্বাচন হবে, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানোর প্রেক্ষিতে আশা করা হয়েছিল, ভাষণে রোডম্যাপ জানানো হবে। তা হয়নি। সংস্কার ও নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কারের কাজ শেষ হলে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটা আর থামবে না। সংস্কারের জন্য নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিত করা যেতে পারে। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল জানিয়েছে, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সরকারের বক্তব্য আরো স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের সংখ্যা উল্লেখ করে শহীদদের পরিবার বর্গের আর্থিক সহায়তা ও আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। স্বৈরাচারের শিকার হয়ে যারা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন তাদের হত্যাকারীদের বিচার করার কথা দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিগত ১৫ বছরের গুম-খুনের বিচার করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। এটা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। গুম-খুন সংক্রান্ত একটি কমিশনও গঠন করা হয়েছে।
পতিত স্বৈরাচার দেশের অর্থনীতিকে রীতিমতো পথে বসিয়ে গেছে। অর্থনীতির প্রতিটি খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি ছিল সাধারণ বাস্তবতা। অর্থ পাচার ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। টিআইবির মতে, প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। ব্যাংকখাত প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ঋণ খেলাপ সীমা ছাড়িয়েছে। খেলাপী ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার মতো। ইতোমধ্যে অর্থনীতির সূচকগুলো চাঙ্গা হতে শুরু করেছে। রিজার্ভ বেড়েছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, রফতানি আয় বেড়েছে। অর্থনীতির এই ইতিবাচক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও তাদের টিমের কারণে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন, আমরা যে লণ্ডভণ্ড অবস্থা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটা এখন অতীত ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এও বলেছেন, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা একটি মজবুত অর্থনীতি দিয়ে যাব। বলা বাহুল্য, মজবুত অর্থনীতি গড়ার জন্য বিভিন্ন দেশ ও আর্থিক সংস্থার উদার সহযোগিতা আবশ্যক, যা এই সরকারের পাওয়ার সম্ভাবনা ড. ইউনূসের কারণে অনেক বেশি। ইতোমধ্যে বিপুল সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, চীন প্রভৃতি দেশ এবং বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭টি দেশের রাষ্ট্রদূতগণের ঢাকায় ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে কয়েকদিনের মধ্যে। এটা একটা বিরল ঘটনা।
এখানে বিশেষভাবে বলার বিষয় হলো, বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতি মজবুত করার সহজ কোনো পথ নেই। এফডিআইসহ বিদেশি বিনিয়োগ, দেশি বিনিয়োগ কোনো ক্ষেত্রেই আশাবাদী হওয়ার মতো নয়। বিনিয়োগ আনতে বা বাড়াতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অপরিহার্য। এইসঙ্গে উৎপাদনসহায়ক ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে গ্যাস-বিদ্যুৎ ইত্যাদির পর্যাপ্ত সংস্থান জরুরি। এসব ক্ষেত্রে আমাদের ঘাটতি আছে, যা পূরণ করতে হবে।
দেশব্যাপী কর্মের জোয়ার তৈরি করতে হবে। এজন্য সর্বক্ষেত্রে বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সরকারকে এই লক্ষাভিমুখী যাত্রা জোরদার করতে হবে। মূল্যস্ফীতির কথাও এসেছে, যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত দেশের সর্বস্তরের মানুষ। মূল্যস্ফীতি সীমা অতিক্রম করে গেছে। তাতে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। অবিলম্বে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে হবে। অনেকের মতে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০০ দিনের কাজের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা যদি মন্ত্রণালয় ভিত্তিক দিতেন তাহলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তাদের উপদেষ্টাদের সাফল্য-ব্যর্থতার একটা চিত্র পাওয়া যেতো। ইতোমধ্যে কথা উঠেছে, উপদেষ্টাদের বেশিরভাগই অকর্মন্য, দুর্বল এবং অদক্ষ। এসব উপদেষ্টা বহাল রেখে সরকারের সফল হওয়া খুবই কঠিন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্ভাবনা অপার। সে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে নজির সৃষ্টিকারী উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত হতে পারে। সর্বোপরি জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের স্বপ্ন ও আকাঙ্খা বাস্তবায়িত হতে পারে।
সরকারের বিরুদ্ধে পতিত স্বৈরাচার, তার দোসর এবং ভারতের মোদি সরকার একের পর এক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিকগুলোর সহায়তায় সরকার কৃতিত্বের সঙ্গে এ ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করে আসছে। ড. ইউনূসের ভাষণে এ বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সবারই জানা, দেশে প্রায় ১৬ বছর গণতন্ত্র নেই, ভোটাধিকার নেই। গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারের জন্য এদেশের মানুষ লাগাতার সংগ্রাম করে স্বৈরাচার হটিয়ে দিয়েছে।
সুতরাং, এই সরকারের অপরিহার্য দায়িত্ব দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণ নিশ্চিত করা। এ জন্য নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আশা করবো, গণতন্ত্রের পথের অভিযাত্রাকে সরকার যথোচিত গুরুত্ব দেবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরই সরকারের ছুটি। সেই লক্ষ্যে কাজ যত দ্রুত হবে, ততই মঙ্গল। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে অনেক সংকট-সমস্যা আর থাকবে না- কেটে যাবে ধারণা পর্যক্ষেক মহলের।