মিথ্যা মামলা ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে : বিচারপতি হাফিজ

দেশবাসীকে নীতি-নৈতিকতা ভুলে মুহূর্তেই বড়লোক হওয়ার মানসিকতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে অবসরে যাওয়া বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ। তিনি বলেছেন, এ ধরণের মানসিকতা দেশকে বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ বিপর্যয় ঠেকাতে তিনি দেশবাসীর মধ্যে সৃজনশীলতা, ক্ষমা-ভালোবাসা, জ্ঞান-দক্ষতা, অনুসন্ধিৎসা, ন্যায়বিচার-মহত্বের উৎসাহ যোগানোরও আহ্বান জানিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার (৩০ মে) আপিল বিভাগের ২ নম্বর বিচার কক্ষে অনুষ্ঠিত নিজের বিদায় অনুষ্ঠান থেকে তিনি এ আহ্বান জানান। রীতি অনুযায়ী বিচারিক পেশার শেষ দিনে বিচারপতিদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানো হয়।
আরও পড়ুন: দুর্নীতির মামলায় সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ কারাগারে
সে জন্য বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করে থাকে সুপ্রিম কোর্ট। আর এতে অংশ নেয় অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
বিদায় অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বিচারপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাফিজের পারিবারিক, শিক্ষা ও কর্মজীবনের নানাদিক তুলে ধরেন।
আরও পড়ুন: সাবেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে খালাস দিলেন হাইকোর্ট
এরপর লিখিত বক্তব্য দেন বিচারপতি হাফিজ। চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যে উঠে আসে বিচার বিভাগ, বিচারকাজ, অপরাধের ধরণ, দুর্নীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, মূল্যবোধসহ নানা বিষয়।
তিনি বলেন, ‘সময়ের বিবর্তনে অপরাধের ধরণ পাল্টে যাচ্ছে, যা আমাদের সন্তানদের ভয়াবহ অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে অভিভাবকদের।
কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান, মাদক, সামাজিক অনাচার, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, হুমকি ও আশঙ্কার বিস্তার ঘটেছে। আর এগুলো আমাদের টেকসই উন্নয়ন, শান্তি, ভালোবাসা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রক্তপাত, স্বার্থপরতা ও ধ্বংসাত্বক কার্যকলাপ থেকে দেশবাসীকে বিরত রাখতে হবে। সততার সাথে জীবন-যাপনে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ।
বিচার বিভাগের দায়িত্ব ও সঙ্কট নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিচারপতি হাফিজ জনবল সঙ্কট ও বিচারক নিয়েগের কথা উল্লেখ করেন তার লিখিত বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘সম্পদ-সম্পত্তি, নারী ও শিশু নির্যাতন, অধিকার নিয়ে প্রতিনিয়ত মিথ্যা মামলা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিচার বিভাগকে এসব মিথ্যা মামলার ভার বহন করতে হচ্ছে। মিথ্যা মামলায় আদালতের প্রচুর সময় নষ্ট হচ্ছে। মিথ্যা মামলা ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
দুর্নীতির প্রভাব ও ব্যপকতা তুলে ধরে শেষ কর্মদিবসে এ বিচারপতি বলেন, ‘দুর্নীতি আমাদের সকল অর্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দুর্নীতির ব্যাপকতা অনেক। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের হাত থেকে অফিস-আদালতকে মুক্ত রাখতে হবে। একজন বেতনভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারী কিবাবে কোটি কোটি এমনকি শতকোটি টাকার মালিক হন তা দেশবাসীকে হতবাক করে। এগুলো রোধ করতে পারলে মানুষ অযাচিত বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।’ স্বাধীনভাবে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য বিচারকদের স্বাধীন চিত্তের হতে আহ্বান জানান অবসরে যাওয়া বিচারপতি হাফিজ।
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারক পদের মেয়াদ ৬৭ বছর। বিচারপতি মুহাম্মদ আবদুল হাফিজের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১ জুন। সে হিসাবে কাল (৩১ মে) তার শেষ কর্মদিবস। কিন্তু ওই দিন সাপ্তাহিক বন্ধের দিন হওয়ায় একদিন আগেই বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বিচারপতি হাফিজ ২০০৩ সালের ২৭ এপ্রিল হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। দুই বছর পর ২০০৫ সালের ২৭ এপ্রিল তার নিয়োগ স্থায়ী করা হয়। হাইকোর্টে স্থায়ী নিয়োগের ১৯ বছর পর গত ২৪ এপ্রিল তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরদিন শপথ নেওয়ার মধ্যদিয়ে তার নিয়োগ কার্যকর হয়। সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে তিনি ৩৭ দিন বিচারিক দায়িত্ব পালন করেছেন।