ডেঙ্গু আতঙ্কের মধ্যে করোনা নিয়ে উদ্বেগ

প্রচণ্ড শরীর ব্যথাসহ ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি-কাশি, বিপর্যস্ত জনজীবন

Shakil
মোয়াজ্জেম হোসেন
প্রকাশিত: ৭:৩৮ পূর্বাহ্ন, ২৯ অগাস্ট ২০২৩ | আপডেট: ৭:৪৬ পূর্বাহ্ন, ২৯ অগাস্ট ২০২৩
সংগৃহীত
সংগৃহীত

মৌসুমি ফ্লু, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ডেঙ্গুতে কাবু রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ। চার ধরনের জ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভিড় বাড়ছে রোগীদের। তাদের সবারই জ্বরের সঙ্গে কমবেশি সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও অন্যান্য উপসর্গ রয়েছে। জ্বর যে কারণেই আসুক, রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে বড় আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু হলো কিনা। হাসপাতালগুলোতে এসব জটিলতা নিয়ে আসলে চিকিৎসকরাও দিচ্ছেন ডেঙ্গু পরীক্ষা। দেখা গেছে, পরীক্ষায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও অধিকাংশই ভুগছেন মৌসুমি জ্বরে। সঙ্গে আছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রকোপও। স্থিতিশীল থাকলেও এখনো নির্মূল হয়নি ভাইরাসটি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য অবহেলাতেই ঘটতে পারে বিপদ। তাই যে কোনো জ্বরই দেখা যাক না কেন, নিকটস্থ হাসপাতালে যাওয়ার তাগিদ তাদের। যাদের কো-মরবিডিটি (একসঙ্গে একাধিক জটিল রোগ) রয়েছে, তাদের মাস্ক ব্যবহারের প্রতি জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা।

আরও পড়ুন: আয়কর রিটার্নে ‘জিরো রিটার্ন’ নামে কোনো ব্যবস্থা নেই: এনবিআর

রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি একাধিক হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগী জ্বর, মাথাব্যথা, গলাব্যথাসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগী। তবে পরীক্ষায় অনেকের ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও অধিকাংশই মৌসুমি জ্বরে আক্রান্ত বলে জানান চিকিৎসকরা। তিন হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, নমুনা পরীক্ষায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ রোগীর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলেন, ‘জ্বর আসলে কোনো রোগ না, এটা রোগের লক্ষণমাত্র। শরীরে কোনো রোগজীবাণুর সংক্রমণে সাধারণত জ্বর হয়ে থাকে। এই সিজনে ডেঙ্গু, করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও টাইফয়েডের প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে।’

আরও পড়ুন: ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা জোরদার করতে সংগ্রহ করা হচ্ছে ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা

তিনি বলেন, ‘বাচ্চাদের ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে কারণ প্রথমত তারা মশার কামড়ের ব্যাপারে বড়দের মতো সচেতন থাকে না। যেসব গর্ভবতী মায়ের ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়, তাদের বাচ্চাদের শরীরে মায়ের কাছ থেকে অ্যান্টিবডি যায় এবং পরিবর্তী সময় বাচ্চা ভিন্ন সেরোটাইপ দিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে খুব দ্রুত শক সিন্ড্রোম বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার হতে পারে। তা ছাড়া বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত সুষম খাবার এবং তরল খায় না বলে জটিলতা বেড়ে যায়।’

কোভিডের পর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ডেডিকেটেড করা হয়েছে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতাল। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজার ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল সোমবার পর্যন্ত ২৭১ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিল হাসপাতালটিতে। প্রতিদিন বহিঃবিভাগ ও ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৪০০ জনের ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে। বর্তমানে থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টির আগে হাসপাতালটিতে রোগীদের ডেঙ্গু শনাক্তের হার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৩০ শতাংশে উঠেছে। তবে বর্তমানে অন্যান্য পরীক্ষা কমেছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছে তাদের এনএস-১ ছাড়াও রক্ত পরীক্ষা, লিভার ফাংশন ও হার্ট পরীক্ষা করতে হচ্ছে। ২০ দিন আগে সব মিলিয়ে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা ১২শ থেকে ১৫শ হলেও বর্তমানে তা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের বহিঃবিভাগে প্রতিদিন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ রোগী আসছে চিকিৎসা নিতে। এর মধ্যে ৪০০-৫০০ রোগীই জ্বর, সর্দি ও নাক বন্ধ হওয়াসহ শাসতন্ত্রের সমস্যা নিয়ে আসা। তবে পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্তের হার কম বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

হাসপাতালটির ল্যাব ইনচার্জ মো. জিল্লুর রহমান আমাদের সময়কে জানান, ‘বর্তমানে ডেঙ্গু শনাক্তের এনএস-১ ও আইজিজি পরীক্ষা ১৫০ থেকে ১৭০টির মতো হচ্ছে। এতে ডেঙ্গু পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। অধিকাংশই সাধারণ ঠা-াজনিত সমস্যায় ভুগছে।’

শিশু হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. লুনা পারভীন বলেন, ‘ঠাণ্ডাজনিত রোগী আসার হার অনেক বেশি। তবে ডেঙ্গুর বৈশিষ্ট্য যেহেতু সাধারণ জ¦রের মতোই, তাই পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেও সেটাকে পজিটিভ হিসেবেই দেখছি আমরা। কারণ ভাইরাসটির আচরণগত পরিবর্তনের কারণে রোগীর জটিলতায়ও ভিন্নতা এসেছে। এমনকি মাত্র জ্বর এসেছে, সেই বাচ্চাকে বাসা থেকে হাসপাতালে আনতে আনতেই পালস পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’

ডা. লুনা পারভীন বলেন, ‘কম বয়সীরা এসব অসুস্থতায় ভুগছে এবং দ্রুত অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। যার বড় কারণ স্থূলতা (ওবিসিটি)। আবার লক্ষণ দেখা দিলেও অভিভাবকদের অনেকেই এখনো সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।’ জ্বর এলেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া এবং ডেঙ্গু পরীক্ষা করার পরামর্শ এই চিকিৎসকের।

এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু চিকিৎসায় সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে মুগদা মেডিক্যালকে। সাড়ে ৮ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনো চিকিৎসাধীন তিন শতাধিক রোগী। বর্তমানে সেখানে প্রতিদিন ডেঙ্গু পরীক্ষা হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০টি। এতে ডেঙ্গুর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে ১০ শতাংশের বেশি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বর্তমানে চার ধরনের জ্বরে ভুগছে মানুষ। সাধারণ জ্বরে সর্দি ও মাথাব্যথা হয়ে দু-একদিনেই ভালো হয়ে যায়। সিজনাল ফ্লুতে তিন-চারদিন জ্বরের পাশাপাশি নাক বন্ধ হওয়া, শরীর ব্যথা থাকে। কোভিড তো আছেই। আর ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এসব বৈশিষ্ট্য থাকায় অনেক সাধারণ মানুষ যে কোনো জ্বর হলেই ডেঙ্গু ভাবছে। অনেকক্ষেত্রে হচ্ছেও তাই। যেসব রোগী এখন হাসপাতালে আসছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশের ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। তবে যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে, তাদের নিয়েই বিপদ। এসব রোগীর নিয়মিত মাস্ক পরা উচিত।’

জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ফ্যাকাল্টি মেম্বার ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরের অধিকাংশ মানুষ ইতোমধ্যে আক্রান্ত, এখন গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। তবে গ্রামে এবারই প্রথম ব্যাপকভাবে বিস্তার ঘটনায় সেখানে মৃত্যু কম, ঢাকায় একাধিক ধরনে সংক্রমিত হওয়ায় মৃত্যু বেশি। এতে করে সাধারণ মানুষসহ চিকিৎসকরা জ্বর হলেই ডেঙ্গু ধরে নিচ্ছেন। এর যথেষ্ট কারণও আছে। এ জন্য মশক নিধন অত্যন্ত জরুরি।’

ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, ‘ঢাকা শহরে সামান্য হলেও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি আছে; কিন্তু গ্রামে নেই। অথচ সেখানে হুহু করে রোগী বাড়ছে। বৃষ্টি হলেও একেবারে ভারী বর্ষণ হচ্ছে না, ফলে ডেঙ্গুকে আরও উস্কে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে মশা নিয়ে গবেষণা হওয়া জরুরি। সংকট অবস্থা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও এগিয়ে এসেছে। তাই সরকার চাইলে কীটতত্ত্ববিদদের একটি বিভাগ চালুর উদ্যোগ নিতে পারে। এতে করে সামনের পরিস্থিতি মোকাবিলা অনেকটাই সহজ হবে। তা না হলে আগামীতে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু মহামারী রূপ নেবে।’