শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়ার খবর প্রথম যেভাবে নিশ্চিত করেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যান। এই খবরটি সবার আগে কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানিয়েছেন, সেদিন দুপুর ১টার আগেই তিনি এই চাঞ্চল্যকর খবরটি পান এবং অনেক ঝুঁকি নিয়ে তা নিশ্চিত করেন।
শফিকুল আলম বলেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারছিলেন যে, বিপুল সংখ্যক মানুষ ঢাকার দিকে আসছে। দুপুর ১২টার দিকে তিনি দেখতে পান, শহরের বিভিন্ন স্থানে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে তার মনে গণভবনের ভেতরের পরিস্থিতি জানার আগ্রহ তৈরি হয়।
আরও পড়ুন: আগামী নির্বাচন হবে গণতন্ত্রের নতুন ভিত্তি : প্যারিসের মেয়রকে অধ্যাপক ইউনূস
তিনি বলেন, "দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে আমি এক পরিচিত ব্যক্তিকে ফোন করি। তিনি আমাকে জানান যে, শেখ হাসিনা গণভবন ছেড়ে চলে গেছেন এবং সম্ভবত ভারতেও চলে যেতে পারেন।"
শফিকুল আলম তাৎক্ষণিকভাবে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই খবরটি জানান। কিন্তু যেহেতু খবরটি একটি মাত্র সূত্র থেকে এসেছিল এবং সেই সূত্র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছিল, তাই খবরটি প্রকাশ করা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
আরও পড়ুন: জাতিসংঘে একাধিক বৈঠক করলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিশ্বনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়
তিনি বলেন, "বসরা আমাকে সতর্ক করেন যে, যদি শেখ হাসিনা ফিরে আসতেন, তাহলে আমার খবরটি মিথ্যা প্রমাণিত হতো। আর যদি তিনি ক্ষমতায় টিকে যেতেন, তাহলে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হতো। এতে আমার গুম হয়ে যাওয়া বা মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিও ছিল।"
এএফপির সাংবাদিকরাও একই ধরনের সতর্কবার্তা দেন। তারা জানান, দ্বিতীয় কোনো সূত্র থেকে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত খবরটি প্রকাশ করা যাবে না।
এরপর শফিকুল আলম অন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে খবরটি নিশ্চিত হন। দ্বিতীয় সূত্র তাকে আরও বিস্তারিত তথ্য দেন। তিনি জানান, উত্তরা থেকে প্রায় ৫ লাখ এবং শনির আখড়া ও যাত্রাবাড়ী থেকে আরও সাড়ে ৩ লাখ মানুষ ঢাকার দিকে আসছিল। নিরাপত্তা বাহিনী (এসএসএফ) জানায় যে, এত বিশাল জনস্রোত ঠেকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এত মানুষকে গুলি করে হত্যা করে ক্ষমতায় টিকে থাকাও অসম্ভব ছিল। এই পরিস্থিতিতেই শেখ হাসিনাকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর দল বাংলাদেশ-চায়না সেন্টারের দিকে রওনা দেয়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, সেখান থেকে জাহাঙ্গীর গেট হয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে কুর্মিটোলা এয়ারবেস হয়ে বিমানবন্দরে যাওয়া। কিন্তু তারা খবর পান যে, উত্তরা থেকে আসা জনস্রোত ততক্ষণে বিমানবন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এই পথে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ মনে হওয়ায় তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে যান এবং সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে স্থান ত্যাগ করেন।
সব তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর শফিকুল আলম পুরো ঘটনার বর্ণনা লিখে পাঠান। এর পরপরই এএফপি থেকে শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার খবর ব্রেকিং হিসেবে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব সংবাদপত্র এবং টিভি চ্যানেল এএফপিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে এই খবরটি প্রচার করে।
সংবাদ প্রকাশের পর শফিকুল আলম আরও বেশি দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তিনি বলেন, "আন্তর্জাতিকভাবে খবরটি ছড়িয়ে যাওয়ার পর আমি টেনশনে সুরা-কেরাত পড়া শুরু করি। যদি তিনি ফিরে আসতেন, তাহলে আমার জীবনই শেষ হয়ে যেত।"
তবে এই অনিশ্চয়তার অবসান ঘটে দুপুর ২টার দিকে। বিটিভির স্ক্রলে "সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন" খবরটি দেখে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হন যে, শেখ হাসিনা চলে গেছেন। তখনই তার ভয় পুরোপুরি কেটে যায়।