সকল রাজনৈতিক দলের কাছে কপি পাঠানো হয়েছে
জুলাই সনদ চূড়ান্ত, যেসব বিষয়ে একমত বা ভিন্নমত রাজনৈতিক দলগুলোর

রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক বৈঠকের পর জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া মঙ্গলবার দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার পাঠানো এই সনদে আগামী শুক্রবার স্বাক্ষর করার কথা রয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর।
দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই জাতীয় সনদে সংস্কার কমিশনে আলোচনা হওয়া ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত বা ভিন্নমতের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন: আন্দোলনরত শিক্ষকরা ফের শহীদ মিনারে, কাল শাহবাগে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা
তবে জুলাই জাতীয় সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক বিবেচনা করা হচ্ছে সাত দফা অঙ্গীকারনামাকে। যার তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে এই সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবে না দলগুলো।
আর অঙ্গীকারনামার শেষ দফায় বলা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়েই বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তী সরকার।
আরও পড়ুন: রেমিট্যান্সেই টিকে ছিল অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার: প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, সনদের বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হলেও নতুন করে দলগুলোর কাছ থেকে আর কোনও মতামত নেবে না ঐকমত্য কমিশন।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ।
কোন প্রেক্ষাপটে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটিও যুক্ত করা হয়েছে জুলাই সনদে।
আগামী শুক্রবার সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। ইতিমধ্যে অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদের তিনটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আছে সনদের পটভূমি। দ্বিতীয় ভাগে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব এবং তৃতীয় ভাগে আছে সনদ বাস্তবায়নের ৭ দফা অঙ্গীকারনামা।
সনদের অনেকগুলো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হলেও অনেকগুলো বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ কিছু কিছু রাজনৈতিক দল।
জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
প্রতিটি দল থেকে জুলাই সনদে সই করবেন দুইজন প্রতিনিধি। এরই মধ্যে জুলাই সনদে সই করতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দুজন করে প্রতিনিধির নাম ঐকমত্য কমিশনে পাঠিয়েছে।
ঐকমত্যের ঘোষণায় যা বলা হয়েছে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সনদের চূড়ান্ত খসড়ার ঘোষণায় বলা হয়েছে- "জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে পারস্পারিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা স্ব স্ব দলের পক্ষ থেকে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।''
যার ক ধারায় বলা হয়েছে- 'বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিন্মলিখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি।
'খ' ধারায় বলা হয়েছে - কিছু বিষয়ে ভিন্নমতসহ উল্লেখিত বিষয়কে জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছে দলগুলো।
আর 'গ' ধারায়- ২০০৯ সাল পরবর্তী ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের আহত-নিহত, কারাবরণকারী ও অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' হিসেবে ঘোষণা করার কথাও বলা হয়েছে ঐকমত্যের ঘোষণায়।
জুলাই জাতীয় সনদের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে যে ৪৭টি সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত। সংবিধান সম্পর্কিত ধারাগুলো সংস্কারের জন্য সংসদের প্রয়োজন হবে। বাকি যে ৩৭টি সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে সে সব বিষয়ে নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার কথাও বলা হয়েছে অঙ্গীকারনামায়।
৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের যেগুলোতে নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত দিয়েছে দলগুলো তা, সংস্কার প্রস্তুাবের পাশেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছিল কোন রাজনৈতিক দল যদি কোন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে থাকে তাহলে সেই সংস্কার প্রস্তাব ওই দল ক্ষমতায় গেলে তা মানতে বাধ্য নয়।
যেসব বিষয়ে একমত ও ভিন্নমত একমত যে সব ইস্যুতে
একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দশ বছর মেয়াদ প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন এই প্রস্তাবে ৩০টি রাজনৈতিক দলের সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলেও জানানো হয়েছে সনদের চূড়ান্ত খসড়ায়।
ডেপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার পক্ষে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বিএনপি জামায়াতসহ ৩১টি রাজনৈতিক দল ও জোট।
অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে জাতীয় সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত এনসিপিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল।
বিএনপির কিছুটা মত পার্থক্য থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও বিএনপি-জামায়াতসহ ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
৯টি রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে সংবিধানের ধারায় পরিবর্তন আনার পক্ষে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হয়েছে বলেও জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ঐকমত্য হয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের।
জাতীয় সংসদের নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০তে উন্নীত করতে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে সনদে।
ভিন্নমত যে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে
ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। এর মধ্যে কয়েকটি প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে।
এর মধ্যে সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিত করণের বিষয়ে ২৯টি রাজনৈতিক দল একমত হলেও ভিন্নমত জানিয়েছে গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ তিনটি দল।
তবে প্রধানমন্ত্রী যিনি থাকবেন তিনি দলীয় প্রধান বা সংসদ প্রধানের মতো একাধিক পদে থাকতে পারবেন না, এমন বিধানের পক্ষে ২৫টি রাজনৈতিক দল ঐকমত্যে পৌঁছালেও এ নিয়ে ভিন্নমত দিয়েছে বিএনপিসহ ৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট।
সংসদে সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন বিষয়ে শেষ পর্যন্ত মতপার্থক্য রয়ে গেছে। সনদে দেখা গেছে উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে জামায়াত এনসিপিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট একমত হলেও এতে, ভিন্নমত রয়েছে বিএনপিসহ ৭টি রাজনৈতিক দল ও জোটের।
লগুলোর জন্য অঙ্গীকার নামায় যা বলা হয়েছে
রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের জন্য যে জুলাই সনদ ২০২৫ তৈরি করা হয়েছে তাতে দলগুলোর জন্য সাতটি অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করা হয়েছে।
এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, 'জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে রাজনৈতিক দলগুলো।
দুই ধারায় বলা হয়েছে- আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ গ্রহণ করেছি বিধায় এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্ত ভাবে সংযুক্ত করা হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে অঙ্গীকারনামার তিন ধারাটি। এই ধারায় বলা হয়েছে- জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবে না দলগুলো। একই সাথে এই সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
চতুর্থ দফায়- গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করার কথা বলা হয়েছে।
পঞ্চম দফার ঘোষণায়- 'গণঅভ্যুত্থান-পূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-কালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
ষষ্ঠ দফায়- জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সহযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছে।
আর শেষ দফায়, জুলাই জাতীয় সনদে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।