নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিই বড় চ্যালেঞ্জ
মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট, ডেভিল হান্ট, গানম্যান ও প্রার্থীদের অস্ত্রের লাইসেন্সও কাটছে না আতঙ্ক
গত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় দিনে দুপুরে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা ঘটে। এক সপ্তাহ পর তার মৃত্যুর খবর আসার পর পরই ১৮ই ডিসেম্বর মধ্যরাতে বাংলাদেশের অন্যতম দুই সংবাদ মাধ্যম প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা হয়। কয়েকদিনের ব্যবধানে ঘটে যাওয়া বড় এই দুই ঘটনায় আইনশৃ্ঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গুলির ঘটনার পরপরই ওসমান হাদির হামলাকারীরা ভারতে পালিয়ে গেছে বলে দাবি করছে পুলিশ। তবে তারা কীভাবে আইনশৃ্ঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে পালালো এ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন রাজনীতিবিদসহ অনেকেই।
আরও পড়ুন: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল সংশোধন
আজ ২০শে ডিসেম্বর ওসমান হাদির জানাজার জায়গা জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকেই ইনকিলাব মঞ্চ ঘোষণা করেছে, হত্যাকারী বা খুনিচক্রের বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটা করা না হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখস চৌধুরীকে পদত্যাগের আহ্বান ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের।
গত বৃহস্পতিবার রাতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের শিকার হয়ে একদিন প্রকাশনা বন্ধ রাখতে হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে। দুটি প্রতিষ্ঠানই অভিযোগ তুলেছে, হামলাকারীরা আসছে এমন খবর পেয়ে তারা পৌঁছানোর আগেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। তবে সময়মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা না করা ক্ষতি এড়ানো যায়নি।
আরও পড়ুন: রোববার তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বসছেন সিইসি
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার রাতেই ঢাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, রাজশাহী-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর, সহিংসতা হয়।
হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়া থেকে শুরু করে দেশের শীর্ষ দুটি পত্রিকা অফিসে হামলা এবং অন্যান্য সহিংসতাকে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র এবং নির্বাচন ঠেকানোর অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজন।
বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলো যখন প্রার্থী চূড়ান্ত করা এবং আনুষ্ঠানিক প্রচারণার প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেমময় একের পর এক নানা অপরাধমূলক ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, দেশটিতে নির্বাচনের জন্য যে ব্যাপক মাত্রার নিরাপত্তা দরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটার জন্য কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশে অপরাধের চিত্র এখন কেমন?
বাংলাদেশে অপরাধের চিত্র নিয়মিত মনিটরিং করে দেশটির পুলিশ সদর দপ্তর। দেশটির প্রতিটি থানার মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে অপরাধের একটি তালিকা আসে সদর দপ্তরে।
যদিও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন বাস্তবে যত অপরাধ ঘটে, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ থানায় নথিভুক্ত হয় না।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, দেশটিতে বিশেষত গত এক বছরে অপরাধের যে বাড়দি চিত্র তার মূল কারণ চুরি-ডাকাতি এবং পুলিশের উপর হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়া।
তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, অপহরণের মতো ঘটনা ঘটেছে আঠারো হাজার চুয়ান্নটি।
কিন্তু চলতি বছরের প্রথম এগার মাস অর্থাৎ নভেম্বর পর্যন্ত এমন অপরাধ ঘটেছে ১৯ হাজার ৫৫৫টি।
অর্থাৎ একবছরে অপরাধের ঘটনা বেড়েছে দেড় হাজার।
আবার ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর -এই তিন মাসের সঙ্গে চলতি বছরের একই মাসগুলোর অপরাধের তুলনা করলেও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র দেখা যায়।
তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালের ওই তিনটি মাসে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, অপহরণের মতো অপরাধের ঘটনা চার হাজার ৪০০ টি। কিন্তু চলতি বছরের ওই একই মাসগুলোতে অপরাধ বেড়েছে। যার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৬৫০টি।
অর্থাৎ তিন মাসের তুলনা করলে অপরাধ বেড়েছে এক হাজার ২৫০টি।
ওসমান হাদির ওপর যেদিন গুলির ঘটনা ঘটে, সেদিনই দুইটি জেলা লক্ষ্মীপুর ও পিরোজপুরে উপজেলা নির্বাচন অফিসে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ১৩ ই ডিসেম্বর আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, যারা আসন্ন নির্বাচনে অংশ নেবেন, তারা যদি আগ্নেয়াস্ত্র চান, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হবে। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া যাদের আগ্নেয়াস্ত্র সরকারের কাছে জমা থাকে, সেগুলো ফেরত দেওয়া হবে।
লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে 'অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেইজ-২' চালু করা হবে বলেও সেদিন জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
ওই দিনই পুলিশকে পাঠানো পৃথক দুটি চিঠিতে, সারা দেশে সব নির্বাচন অফিস এবং এগুলোর কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন এবং রিটার্নিং অফিসারদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য গানম্যান নিয়োগের ব্যবস্থা করতে বলে নির্বাচন কমিশন।
তবে এরপরও নানা রকম সহিংসতা থেমে নেই। গত বৃহস্পতিবার দিনই ময়মনসিংহে অনেক মানুষের সামনে সনাতন বা হিন্দু ধর্মের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে মরদেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শুক্রবার ঢাকায় উদীচী কার্যালয়ে আগুনের ঘটনা ঘটে যেটাকে নাশকতা বলছেন ওই শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এর জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতাকেই দায়ী করছেন।
তিনি বলেন, "যে ধরনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিত থাকার কথা অর্থাৎ যে ধরনের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন সেই জায়গাটা তৈরি হচ্ছে না। কখনো মনে হচ্ছে, পরিস্থিতি একটু ভালোর দিকে যাচ্ছে। আবার কিছুদিন পরই সেটা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। অর্থাৎ নতুন কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হলে সেটাকে দ্রুততার সঙ্গে মোকাবিলা করার সক্ষমতা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে পরির্পূণভাবে তৈরি হয়নি।"
এরমধ্যেই আবার আছে বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের একটা অংশ দেড় বছরেও উদ্ধার না হওয়া।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবে এখনো পর্যন্ত বিশ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
যেখানে আছে এলএমজি, এসএমজির মতো মারণাস্ত্র থেকে শুরু করে শটগান, পিস্তলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র।
একদিকে সব অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া, অন্যদিকে প্রচলিত অপরাধ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক কিংবা টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনা নিরাপত্তা নিয়ে ভীতি বাড়িয়েছে।
এমনকি নির্বাচনের এই সময়ে এসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে পারছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ওসমান হাদীর উপর গুলিবর্ষণের ঘটনা ইঙ্গিত করে গণমাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, "এরকম ঘটনা আরো ঘটতে পারে।"
অন্যদিকে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, "জননিরাপত্তার বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে সরকারের। আইন-শৃঙ্খলার জায়গায় মানুষের আস্থা এখনো আসে নাই"।
সরকার কী করছে?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে এখন মূলত কয়েকটি পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে।
এক. ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট বাড়ানো, টহল কার্যক্রম জোরদার করা।
দুই. দ্বিতীয় ধাপে অপারেশন ডেভিল হান্ট নামে যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু করা। এসব অভিযানে ইতোমধ্যেই আটকের সংখ্যা প্রায় চার হাজার।
তিন. রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য অস্ত্রের লাইসেন্স ও গানম্যান নিয়োগের সুযোগ সহজ করা। সরকার ইতোমধ্যেই এরজন্য নতুন নীতিমালাও জারি করেছে।
এসবের বাইরে নির্বাচনের জন্য পুলিশ সদস্যদের আলাদা প্রশিক্ষণও শুরু করেছে সরকার।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরির্শক (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বিবিসি বাংলাকে বলেন, তারা ইতোমধ্যেই দেড় লাখ পুলিশ সদস্যের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, "আমাদের মূল ইস্যুই হচ্ছে, কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আমরা অনেকগুলো রিস্ক অ্যাসেসমন্টেও করেছি। একেক আসনে একেকরকম ঝুঁকি। আমরা ঝুঁকি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করে দেখেছি, কীভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।
আর কোনো প্রার্থী যদি মনে করে যে, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করলে পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।"
'প্রতিরোধমূলক আটক' করতে হবে
তবে পরিস্থিতির উন্নতির জন্য গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধমূলক আটকের উপর জোর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে পুলিশ মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলছেন, নির্বাচনকে ঘিরে আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অসম্ভব কিছু নয়। তবে এর জন্য ঘটনা ঘটার আগেই বাহিনীগুলোকে তৎপর হতে হবে।
"ঘটনা ঘটে গেলে তো আর প্রতিকার করা যায় না। সেটা তো ড্যামেজ হয়েই গেলো। কিন্তু ঘটনা যেন না ঘটতে পারে, সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে একটা বড় হাতিয়ার হচ্ছে, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। কারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে তাদের সম্পর্কে তথ্য থাকতে হবে," বলেন তিনি।
তার মতে, যদি আগাম তথ্য জোগাড় করা যায় এবং সম্ভাব্য অপরাধীদের ধরা যায় তাহলে অপরাধ কমে আসবে।
"দরকার হলে প্রতিরোধমূলক আটক করতে হবে। এবং তারা যেন নির্বাচনের আগে বের হতে না পারে সে চেষ্টা করতে হবে," বলেন সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা।
বাংলাদেশে এর আগেও অপরাধী ধরতে যৌথবাহিনীর প্রথম দফার অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু তাতে করে যে অপরাধের সংখ্যা কমেনি পুলিশ সদর দপ্তরের হিসেবেই সেটা স্পষ্ট।
ফলে একদিকে অভ্যুত্থান পরবর্তী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে দুর্বলতা, অন্যদিকে নির্বাচনের বহুমুখী জটিলতা -সবমিলিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার নাগরিকদের মধ্যে কতটা আস্থা তৈরি করতে পারছে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
তবে, ১৮ই ডিসেম্বর রাতে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার বিষয়ে পরদিন ১৯শে ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া একটি বিবৃতিতে 'ন্যায়বিচারের আশ্বাস' দিয়ে বলা হয়, "নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না"।
আসন্ন নির্বাচন ও গণভোটকে "একটি গুরুতর জাতীয় অঙ্গীকার' বলেও সেই বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে সরকার।





