নির্বাচন বানচালে সীমান্ত পথে আসছে অস্ত্র, প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ সতর্কতা
- প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু নির্বাচনি পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা নয়, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এক ধরনের ষড়যন্ত্র: মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশকে অস্থিতিশীল করার নানা ষড়যন্ত্র চলছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে অবৈধভাবে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক আনার চেষ্টা, সীমান্তে চোরাচালান বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কার প্রেক্ষাপটে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন রাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচনি ঘোষণার পর থেকে দেশে নানা ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে বলে রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বিশেষ সূত্রে প্রাপ্ত সেই গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচন বানচাল করতে একটি পক্ষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করতে তারা নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নির্বাচন বানচালে ব্যবহার হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুন: ময়মনসিংহ হিন্দু যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ১০
এদিকে, শরিফ ওসমান হাদির ওপর আক্রমণের পর নিরাপত্তা ইস্যুতে সরকার সতর্কতা বাড়িয়েছে। বিভিন্ন বন্দর দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র, গোলাবারুদসহ নাশকতা সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পণ্য যাতে দেশে প্রবেশ করতে না পারে এ জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। নাশকতা ঘটাতে ড্রোন ব্যবহার করা হতে পারে। তাই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া ড্রোন আমদানিতেও কড়াকড়ি করা হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত বুধবার এনবিআর বিভিন্ন বন্দরে নিয়মিত কর্মকর্তার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষ এ ব্যবস্থা আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরের সাত দিন পর্যন্ত বহাল থাকবে। সব স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দরে সমান গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: তারেক রহমানকে অভ্যর্থনায় ঢাকায় লাখ লাখ নেতাকর্মীর সমাগম হবে: মীর সরফত আলী সপু
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তার সরকারের অনেক এমপি-মন্ত্রী এবং নেতাকর্মীরা সেই দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সূত্র বলছে, সেখানে থেকে আওয়ামী লীগের নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা, ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা দেশে একটি বড় ধরনের শোডাউনের পরিকল্পনা করছে। মূলত নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের জন্য তারা বিভিন্নভাবে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের গোয়েন্দা শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচন বানচাল করার জন্য বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অনেকে উঠেপড়ে লেগেছে। মিথ্যা ঘোষণায় বন্দর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, বোমা বানানোর রাসায়নিক পদার্থ, ড্রোনসহ বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর জিনিসপত্র আনতে পারে বলে গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে। এনবিআর এসব অপতৎপরতা ঠেকাতে গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে।’
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, এরই মধ্যে এনবিআরের প্রধান কার্যালয় থেকে প্রতিটি বন্দরকে সতর্ক থাকতে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে বেনাপোল, সোনামসজিদ, আখাউড়া ও হিলি স্থলবন্দরে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুল মজিদ বলেন, ‘দেশের মধ্যে নাশকতা সৃষ্টি করতে এর আগেও বিভিন্ন সময় মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র, গোলাবারুদসহ ক্ষতিকর পণ্য প্রবেশের সময় এনবিআর কর্মকর্তাদের তৎপরতার কারণে ধরা পড়েছে। লোকবল সংকটে সব সময় যে আটকানো সম্ভব হয় তা কিন্তু না। এরই মধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে যে, আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে দেশে নাশকতা সৃষ্টি করতে কিছু ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করছে। এরা মিথ্যা ঘোষণায় অস্ত্র, গোলাবারুদ দেশে আনার চেষ্টা করতে পারে। তাই এনবিআরকে সতর্ক থাকতে হবে।’
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানা থেকে ৫ হাজার ৭৬৩টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। এর মধ্যে এখনও এক হাজার ৩৪২টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। অন্যদিকে একই সময়ে ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮টি গোলাবারুদ লুট হয়েছিল। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭২১টি উদ্ধার করা হলেও এখনও ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়নি। এছাড়াও বিভিন্ন সময় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়েছে।
লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। অন্যদিকে, নির্বাচনের আগে এসএমজির মতো প্রাণঘাতী অস্ত্রসহ রাইফেল, মর্টারশেল, পিস্তল, গুলি ও ভয়ংকর বিস্ফোরক চোরাচালানের মাধ্যমে সীমান্তপথে দেশে আসছে। এর কিছু অংশ ধরা পড়লেও বেশির ভাগই চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। অন্যদিকে পুরস্কার ঘোষণা করেও জুলাই আন্দোলনের সময় পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের মধ্যে এখনও ২৫ শতাংশ উদ্ধার হয়নি। এসব অস্ত্র নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ডিএমপির তথ্য বলছে, গত তিন মাসে রাজধানীতে অন্তত দুই শতাধিক জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় ঘটেছে। ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও যুবলীগসহ অঙ্গসংগঠনের অন্তত তিন হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে ককটেল, বিস্ফোরক ও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মাধ্যমে কক্সবাজার ও টেকনাফ দিয়ে দেশে অস্ত্র আসছে। এসব অস্ত্র আনার পেছনে রয়েছে রোহিঙ্গা চক্রের সদস্যরা। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে যেভাবে অস্ত্র ঢুকছে এরকম পরিস্থিতি কয়েক বছর আগেও ছিল না। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটারের সাতটি পথে পাচারকারীরা অস্ত্র আনছে।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) থেকে জানানো হয়েছে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে ৩০ অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত ১১৪টি অস্ত্র, এক হাজার ৭২৫ রাউন্ড গুলি, ৩৯টি ম্যাগাজিন, ৯টি মর্টারশেল ও ১১টি গ্রেনেড জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি এসএমজি, ১২টি রাইফেল, ২টি রিভলভার, ৩৬টি পিস্তল এবং অন্যান্য অস্ত্র ৬২টি।
জানা যায়, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত সাতটি পথে অবৈধ অস্ত্রের চালান নিয়মিতভাবে দেশে ঢুকছে। এই অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত রয়েছে অন্তত পাঁচটি সংঘবদ্ধ চক্র, যার প্রতিটিতেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের সক্রিয় সম্পৃক্ততা রয়েছে।
সীমান্ত, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এসব অস্ত্রের মূল গন্তব্য কক্সবাজারের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার সন্ত্রাসীদের আস্তানা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মিয়ানমার থেকে যেভাবে অস্ত্র প্রবেশ করছে, এমন পরিস্থিতি গত কয়েক বছরেও দেখা যায়নি। এখন মাদক চোরাচালানের পাশাপাশি মানবপাচারকারী চক্রও যুক্ত হয়েছে অস্ত্র ব্যবসায়, ফলে সীমান্ত পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কক্সবাজারের রামু সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে কিছু অস্ত্র প্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে, তবে সেটির পরিমাণ এখনও নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, ‘বিজিবি অস্ত্র, মাদক ও চোরাচালান প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে এবং গত তিন মাসে ২২টির বেশি দেশি-বিদেশি অস্ত্রের চালান আটক করা হয়েছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু নির্বাচনি পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা নয়, বরং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এক ধরনের ষড়যন্ত্র।’
তিনি বলেন, ‘অতীতেও দেখা গেছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা ক্ষমতার রূপান্তরের সময়কে লক্ষ্য করে কিছু গোষ্ঠী সীমান্ত ব্যবহার করে অস্ত্র ও বিস্ফোরক ঢোকানোর চেষ্টা করেছে। এ ধরনের প্রবণতা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য বড় সতর্কবার্তা।’
এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘নির্বাচন কেন্দ্র করে যেকোনও ধরনের নাশকতা ঠেকাতে এখনই কঠোর নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব ও পুলিশকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ নাগরিকদেরও সচেতন থাকতে হবে, যেন দেশের নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কোনও বিদেশি স্বার্থের বলি না হয়।’
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আগাম তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত আছে। যেকোনও ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড, নাশকতা বা সংঘর্ষের চেষ্টা হলে তাৎক্ষণিক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়াও পুলিশের লুণ্ঠিত অস্ত্র ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’





