বাংলাদেশের রাজনীতি: বিশ্বাসঘাতকতার মাফিয়া শাসন
বাংলাদেশ—একটি স্বাধীন দেশের নাম, যার জন্ম হয়েছে রক্ত, অশ্রু ও ত্যাগের বিনিময়ে; একটি জাতির স্বপ্ন ও আত্মত্যাগের গৌরবময় ইতিহাস। কিন্তু আজ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও এই রাষ্ট্রটি প্রকৃত অর্থে জনগণের নয়; বরং একদল ক্ষমতালোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও বিদেশি স্বার্থনির্ভর রাজনৈতিক মাফিয়ার হাতে বন্দি। এই মাফিয়ারা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা এমনকি জনগণের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে ব্ল্যাকমেইল, ভয় ও প্রতারণার জালে আবদ্ধ করেছে। এরা দেশকে জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে নয়, বরং ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির কলকারখানা হিসেবে ব্যবহার করছে।
ব্ল্যাকমেইল: বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান অস্ত্র
আরও পড়ুন: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও অভিযোজন কৌশল: বাস্তবতা ও সম্ভাবনা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্ল্যাকমেইল কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি একটি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দর্শন। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীরা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত এবং গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করছে, ব্যবসায়ীদের চাঁদাবাজির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সাধারণ জনগণকে ভয় দেখিয়ে নীরব করে রাখছে। মামলা, গ্রেপ্তার, টেন্ডার ও লাইসেন্স—সবকিছুই আজ রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে পাওয়া যায়। রাজনীতিবিদদের এই ব্ল্যাকমেইল সংস্কৃতি শুধু বিরোধী দল দমনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি জনগণের মৌলিক অধিকারকেও ছিনিয়ে নিচ্ছে।
একটি প্রশ্ন উঠে আসে: যখন একজন ব্যবসায়ী তার নিজের সম্পদ রক্ষার জন্য রাজনীতিবিদের ‘দলীয় চাঁদা’ দিতে বাধ্য হন, অথবা একজন সরকারি কর্মকর্তা চাকরি রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রার্থীর পক্ষে ভোট নিশ্চিত করতে বাধ্য হন—তখন কি সেই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক বলা যায়? বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের রাজনীতি আজ আর জনতার নয়; বরং “কন্ট্রোলড পলিটিক্স” যেখানে ব্ল্যাকমেইলই হলো ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রধান পদ্ধতি।
আরও পড়ুন: একজন কল্যাণকামী নেতার সন্ধানে বাংলাদেশ
বিদেশি শক্তির ছায়াশাসন—স্বাধীনতার সার্বভৌমত্ব কোথায়?
আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেকাংশে দেশের ভিতরে নেওয়া হয় না—এটি গৃহীত হয় বিদেশের রাজধানীতে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি ও প্রতিবেশী দেশের স্বার্থ পূরণের মধ্য দিয়ে রাজনীতি পরিচালিত হয়। ভূ-রাজনীতি ও কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে বড় শক্তিগুলো নিজেদের করিডোর হিসেবে দেখতে চায়। ফলে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে টিকে থাকতে হলে বিদেশি শক্তির সন্তুষ্টি অর্জন করাই প্রথম শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
• ভারতের প্রভাব: সীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ চুক্তি এবং ট্রানজিট সুবিধাসহ বহু ইস্যুতে বাংলাদেশ সবসময় নতি স্বীকার করেছে। ভারতীয় স্বার্থ রক্ষার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া পেয়েছে।
• চীনের প্রভাব: ঋণ নির্ভর অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক দাসত্বের ফাঁদ তৈরি হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ বা বন্দর উন্নয়ন—সব ক্ষেত্রেই রয়েছে কমিশন ও রাজনৈতিক মুনাফার হিসাব।
• মার্কিন প্রভাব: মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ভিসা পলিসির নামে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে। কিন্তু তাদের আসল লক্ষ্য হলো অঞ্চলভিত্তিক প্রভাব বিস্তার ও কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ।
এই বাস্তবতায় বাংলাদেশের রাজনীতি আজ সার্বভৌমত্বহীন “প্রক্সি ব্যালান্সিং স্টেট”-এ পরিণত হয়েছে।
দুর্নীতি: ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা
একসময় দুর্নীতি ব্যক্তিবিশেষের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো, কিন্তু আজ এটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা সরকারি প্রকল্পকে কমিশন ভাগাভাগির উৎস হিসেবে ব্যবহার করছেন। সরকারি প্রকল্পের ব্যয় ৩০-৪০% পর্যন্ত ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়, যাতে কমিশন বাণিজ্য নিশ্চিত করা যায়।
উদাহরণ:
• রূপপুর প্রকল্পে বালিশের মূল্য ৬,৭০০ টাকা।
• বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো “ক্যাপাসিটি চার্জের” নামে বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা জনগণের করের টাকা থেকে প্রদান করা হয়, যদিও সেগুলোর অনেকগুলো কখনোই বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায় না।
• ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ২ লাখ কোটি ছাড়িয়েছে, যার বেশিরভাগই রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়ীদের।
এটি স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অর্থনীতি “মাফিয়া কন্ট্রোলড ডেভেলপমেন্ট মডেলে” পরিচালিত হচ্ছে।
নির্বাচন নয়, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার যান্ত্রিক প্রহসনঃ-
বাংলাদেশে নির্বাচন এখন আর জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যম নয়, বরং ক্ষমতা বৈধতা দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন, ২০২৪ সালের নির্বাচনেও প্রশাসন, দলীয় ক্যাডার ও বিদেশি স্বার্থের নির্দেশনায় রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হয়। ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি, কেন্দ্র দখল, নির্বাচন কমিশনকে প্রশাসনের দাসে পরিণত করা—এসব প্রমাণ করে দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে।
যখন জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন রাষ্ট্র একটি নির্বাচিত প্রজাতন্ত্র নয়; বরং একদল মাফিয়ার ব্যক্তিগত সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
জনগণের উপর প্রভাব ও ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ঃ-
এই মাফিয়া-শাসনের পরিণতি সবচেয়ে বেশি ভোগ করছে সাধারণ মানুষ:
• শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য: গ্রামীণ ছাত্র-ছাত্রীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত; শিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করছে কোচিং-মাফিয়া ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী।
• স্বাস্থ্যব্যবস্থা: সরকারি হাসপাতালগুলোতে দুর্নীতি, ওষুধের অভাব, চিকিৎসায় অবহেলা; বেসরকারি হাসপাতালগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
• বেকারত্ব ও যুবসমাজের হতাশা: রাজনৈতিক দালালি অথবা বিদেশে পালানোর পথ ছাড়া যুবকদের সামনে কোনো বাস্তব সুযোগ নেই।
• আইনের শাসন: গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা মামলা সব মিলিয়ে আইন এখন ক্ষমতাশালীদের রক্ষাকবচ, জনগণের নয়।
সমাধান: জনগণের প্রত্যক্ষ ক্ষমতায়নের একটি নতুন চুক্তি
বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন একটি নতুন রাজনৈতিক মডেল, যেখানে—
1. রাজনীতি হবে জনসেবা, ব্যক্তিগত লাভের মাধ্যম নয়।
2. বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করতে হবে জাতীয় ঐক্য ও নীতিনির্ভর কূটনীতি দ্বারা।
3. নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করে গণভোট ও জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
4. দলীয় দখলদারিত্ব ভেঙে প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ করতে হবে।
5. দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে গণ-ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সম্পদ উদ্ধার করতে হবে।
উপসংহারঃ-
বাংলাদেশ আজ একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্রের মালিকানা এখনো জনগণের হাতে ফেরত আসেনি। এই দেশের প্রকৃত মুক্তি কোনো রাজনৈতিক দলের হাত ধরে আসবে না; এটি আসবে জনগণের জাগরণের মাধ্যমে। বিশ্বাসঘাতকতার মাফিয়া রাজনীতি যতদিন টিকে থাকবে, ততদিন জনগণের স্বাধীনতা কাগজে থাকবে, বাস্তবে নয়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কথার ভাষণে নয়, জনগণের বাস্তব প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণে।
অতএব, সময় এসেছে নতুন রাজনৈতিক চুক্তির, যেখানে জনগণ হবে রাষ্ট্রের মালিক এবং রাজনীতি হবে জনগণের মুক্তির হাতিয়ার।





