আর্ট গ্যালারি প্যালেট-এর নবযাত্রা, শিল্পের নতুন গন্তব্য
রাজধানীর উত্তরার ৩ নং সেক্টরের জসীমউদ্দীন এভিনিউয়ের যাত্রা শুরু করেছে গ্যালারি প্যালেট। গত শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) গ্যালারি প্যালেটের যাত্রা শুরু হয়। গ্যালারির শিল্পীত থীম হল, “গ্যালারি তোমারই অপেক্ষায়! সৃজনশীলতা সীমাবদ্ধতা মানে না! যদি নিবেদিতপ্রাণ হও, তবে তোমার কাজ শিল্পরসিকের দৃষ্টিতে পড়বেই। এটা নিশ্চিত। একজন উৎসাহী সংগ্রাহকের লক্ষ্য থাকে মৌলিক শিল্পকর্ম সংগ্রহের প্রতি। একটিই জীবন, প্রতিভার বাঁধ খোলো, রাঙিয়ে তাকে তোলো”।
গ্যালারিটির প্রতিষ্ঠাতা হলেন শরীফ আহমেদ কঙ্কন। তিনি নিজেও একজন ভাস্কর্য শিল্পী। ছেলেবেলা থেকেই বিশেষ করে ড্রইং ও স্কেচ-এর প্রতি দুর্বলতা ছিলো কঙ্কনের। বেড়ে উঠার কালে ভাস্কর্য তাকে চুম্বকের মতন করে টেনে ধরে। কিন্তু কর্মজীবনে একজন পেশাদার হিসাববিদের জগৎ কঙ্কন-কে সে সুযোগ বা অবসর দেয়নি। নিজের জীবনের পর্বগুলো তাই তিনি এমন করে তুলে ধরেন, “দীর্ঘ এক ছাত্রজীবনের পরে, দীর্ঘতর কর্মজীবনের শেষে, মধ্যবয়সে এসে শিল্পীজীবনের শুরু”।
আরও পড়ুন: স্টল ভাড়া কমানোর দাবিতে সমাবেশ ও পদযাত্রা ১১ নভেম্বর
কাকতালীয়ভাবেই, ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাসে কর্মসূত্রে পরিচয় হয় ইউরোপের একজন খ্যাতিমান প্রবীন ভাস্করের সাথে। যার সংস্পর্শে পাঁচ সহস্রাধিক বছরের পুরনো শিল্প ষড়ংঃ ধিী পদ্ধতির গলানো ধাতুকর্মের কাজে হাতেখড়ি হয় শরীফ কঙ্কন-এর। নিবিড় অধ্যবসায় চলে একান্তে, ক্যাডেট কলেজ আদলে আবাসিক শিক্ষায়তনের থিমে তৈরী ‘ছানাগুলো’ শিরোনামে প্রথম কাজটি ৬ষ্ঠ জাতীয় ভাস্কর্য প্রদর্শনীর জন্য ২০২৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক মনোনীত হওয়ায় উৎসাহ তাঁর প্রবলভাবে বেড়ে যায়। বিশ্ববরেণ্য ভাস্কর অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খান ব্যক্তিগতভাবে প্রেরণার মানুষ হিসেবে তার কাজের প্রশংসা করেন।
বৈশ্বিক ও মনস্তাত্বিক সমস্যা সংক্রান্ত ভাবের প্রকাশ ভাস্কর্যের মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রতি আগ্রহ বেশী শিল্পী কঙ্কনের। ধাতু মাধ্যমে কাজে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ভাস্কর্যের পরে চিত্রকলায় তেল-রং নিয়ে আগ্রহ রয়েছে কঙ্কনের। পরীক্ষামূলক কাজে উৎসাহ বেশী। এছাড়া সাহিত্য চর্চায় কবিতা প্রধান বিষয়। কথাসাহিত্যের প্রতিও প্রবল আকর্ষন। সিনেমা আর ফটোগ্রাফির প্রতি রয়েছে অন্য ধরনের দুর্বলতা। মূল কথা, সৃষ্টিশীলতার যে কোনও বিষয় এবং মাধ্যমই ভাস্কর কঙ্কন-এর ধ্যানমগ্ন হবার উপলক্ষ্য।
আরও পড়ুন: জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
গ্যালারির নামকরণ প্যালেট কেন? উত্তরে কঙ্কন বলেন, “রং মেশানোর পাত্রটিই শিল্পীর প্যালেট। নতুন গ্যালারির বহুমাত্রিক কর্ম পরিকল্পনার চিন্তাগুলো একেকটি রঙের মিশেল মনে করেই এ নামটি উপযুক্ত মনে হয়েছে। নামটি সহজ এবং সুললিতও বোধ হয়”। তিনি আরও বলেন, “প্রতিবছর বাংলাদেশে যে সংখ্যায় প্রতিভাবান চিত্রশিল্পী তৈরী হচ্ছেন, শুধু যদি প্রাতিষ্ঠানিক হিসেবটাও ধরি, তার তুলনায় শিল্পীদের কাজ দর্শনার্থীর সামনে তুলে ধরবার জন্য গ্যালারির সংখ্যা অপ্রতুল। সরকারী প্রদর্শনীস্থল যেমন তেমনি ব্যাক্তি উদ্যোগও বাড়ছে না প্রতিবছর। তাছাড়া মৌলিক মননশীল বিনোদনের জন্য চিত্র ও শিল্প প্রদর্শনীগুলো সরাসরি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে। নিজেদের বাড়িতে স্থান সংকুলান করতে পেরে আমরা কিছু একটা অবদান রাখতে পারার আনন্দে এ পথে নেমেছি। শিল্পীদের, শিল্পের অগ্রযাত্রায় পাশে থাকতে চাই। তাই”।
দেশে তরুনদের মধ্যে চিত্রকলার প্রতি প্রচুর আগ্রহ, পাশাপাশি অপার সম্ভাবনা দেখতে পান কঙ্কন। বলেন, “বিশেষ করে শিশুদের শিল্পের প্রতি ঝোঁক লক্ষ্য করার মত। এটা চিরন্তন। তবে অভিভাবকগণের সহায়তা থাকে ক্ষণস্থায়ী, অপরিকল্পিত। যদি সহায়ক পরিবেশ ও সমর্থন নিশ্চিত করা যায়, দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের শিশুরা একেকজন অবশ্যই বিশ্বমানের চিত্রকর হবে”।
তরুণ শিল্পীদের প্রতিভা অন্বেষনে বিশেষ ভূমিকা রাখবে প্যালেট, এমনটাই মনে করেন তিনি। বলেন, “তরুণরাই তো ভবিষ্যত। আজকের প্রথিতযশা প্রবীন শিল্পীও তো একসময় তরুণ ছিলেন। তবে কাজের শিল্পমান বজায় রাখতে পারা চাই। প্রতিভার অন্বেষনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গ্যালারি প্যালেট।
গ্যালারিতে ইতিমধ্যে আগ্রহী শিল্পীদের একক অথবা যৌথ প্রদর্শনীর বিষয়ে আলাপ চলছে। একটি বর্ষপঞ্জি ধরে গুছিয়ে একের পর এক কয়েকটি এক্সিবিশন করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি চলবে চিত্রকর্ম ও তার শিল্পীর সাথে সাধারণ দর্শকের বোঝাপড়া সহজ সাবলীল করে তোলার কর্মশালা। যাতে করে ভবিষ্যতের প্রদর্শনীগুলোতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ছবির ভাষা বুঝতে জানলেই সংগ্রহের আগ্রহ তৈরী হবে। শিল্পের, শিল্পীর জন্য সুদিনের ভিত গড়া যাবে। শিল্পীদের আগ্রহ অনুমান করে দেশে-বিদেশে শিল্প সফর আয়েজনের সম্ভাব্যতা খোঁজা হবে সামনের বছর”।
উদ্বোধনী প্রদর্শনী পূর্বনির্ধারিতভাবে আয়োজন করেন নিজেরই বাল্যকালীন প্রথম শিল্পের হাতেখড়ি যার মাধ্যমে তার প্রথম একক প্রদর্শনী দিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাক্তন, বরেণ্য শিল্পী ওয়াহিদ জামান তার ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতার পর্ব শেষ করেছেন অধ্যক্ষ পদে এক দশক হতে চলেছে। প্রায় দেড়শত চিত্রকর্মে পূর্ন প্যালেট মাসাধিককাল ধরে শিল্পানুরাগীদের আনন্দের উপলক্ষ্য হয়ে চলে। উদ্বোধনী ও সমাপনী উভয় অনুষ্ঠানে দুই শতাধিক শুভানুধ্যায়ীর আগমন তার প্রামানিক চিত্র হয়ে থাকে। বিশ্ববরেণ্য শিল্পী ও দেশবরেণ্য শিল্পসংগঠকগণের পদচারণা প্রদর্শনীর আকর্ষন বাড়ায়। সর্বোপরি একটি সফল আয়োজনের মাধ্যমে আবির্ভূত হলো নতুন আর্ট গ্যালারি, প্যালেট।
আর্ট গ্যালারি প্যালেট তৈরিতে তার সহধর্মিনী মুনিরা বেগম-এর উৎসাহেরও কোন কমতি ছিলো না। ভাস্কর কঙ্কন বলেন, “আমার সহধর্মিনী স্থির স্বভাবের মানুষ, তিনিও পেশাদার হিসাববিদ। শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ কর্মজীবনের শেষে শিল্পময় জগতের মাঝে প্রশান্তির সন্ধানে ব্রতী। বৃক্ষরাজি আর প্রধানত বিড়াল নিয়ে তার অধিকাংশ সময় কেটে যায়। প্রাকৃতিক বৃক্ষ সমাহারে গৃহের সর্বোপরি বাসস্থানের অলংকরণ একরকমের শিল্পীত প্রকাশ যা তার হাতের ছোঁয়ায় বিমূর্ত হয়ে ওঠে। নিজের বাড়ীর পুরোটা ছাদ জুড়ে তার বাগানে পাঁচ শতাধিক উদ্ভিদের জগৎ। বাড়ীর আঙ্গিনাও সুশোভিত। শিল্পের প্রতিও রয়েছে তার বিশেষ অনুরাগ। আর আছে সাহিত্যের প্রতি প্রবল আকর্ষণ, অবসরে বই পড়া তার নেশা”।
মানসে চিরনবীন মধ্যবয়সী এই যুগলের শিল্পের প্রতি ও তার চর্চার ক্ষেত্র তৈরীতে নিঃস্বার্থ নিবেদন আমাদের এই দ্রুতগামী জীবন ও সময়ের জন্য প্রেরণাময় একটি উদ্যোগ। এই মহতী প্রচেষ্টা সর্বান্তকরনে সফলতা ও দীর্ঘায়ূ লাভ করুক।





