ডাকসু নির্বাচন শেষ মুহূর্তের হিসাব কিতাব

Sadek Ali
বাংলাবাজার ডেস্ক
প্রকাশিত: ৮:১৪ পূর্বাহ্ন, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ৮:১৪ পূর্বাহ্ন, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

দীর্ঘ ছয় বছর পর আজ মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ২০২৫। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর নতুন বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের ব্যাপক আগ্রহ ও উৎসাহে এবারের ভোটকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ভিন্নমাত্রার উত্তেজনা।

এবারের নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছে ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত জোট, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদ এবং বামপন্থি সংগঠনগুলোর তিনটি পৃথক প্যানেল। পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ভোটযুদ্ধে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন।

আরও পড়ুন: টিএসসি কেন্দ্রে ৩ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৩৫ শতাংশ

৯০-এর পুনরাবৃত্তি চায় ছাত্রদল

ছাত্রদল এবারের নির্বাচনে ২৭টি পদে প্রার্থী দিয়ে প্যানেল ঘোষণা করেছে। ৯০-এর ডাকসুর পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় তারা। প্রচারণায় তারা ডাকসুর অতীত ইতিহাস তুলে ধরে নানাবিধ সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রতি দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের গণরুম ও গেস্টরুমে না ফেরানোর প্রতিজ্ঞা করেছে তারা।

আরও পড়ুন: ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ চলছে

ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদলের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানেও আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। এবারের নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা আবারও ছাত্রদলকে ভোট দেবে।’

ডাকসু নির্বাচন : সবার আগে ইশতেহার ঘোষণা করল ছাত্রদল

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্রদলের প্যানেলের প্রতিশ্রুতি তাদের ভালো লেগেছে। বিশেষ করে গণরুম ও গেস্টরুম সংস্কৃতি ফিরিয়ে না আনার বিষয়ে ছাত্রদল যে কথা দিয়েছে তাতে তারা খুশি। তবে অনেক শিক্ষার্থী এতে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ছাত্রদলের হাতেই ক্যাম্পাসে প্রথম গেস্টরুম সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। তারা এটি ফিরয়ে আনবে না, তা দেখে তবেই বিশ্বাস করতে হবে।বেশ কৌশলী কাদের-বাকের

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক ঝাঁক নেতৃত্ব নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদ’। নেতৃত্বে রয়েছেন আব্দুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার ও আশরেফা খাতুন। এই প্যানেল নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। কারণ তারা পুরোনো রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রভাব কাটিয়ে উঠেছে এবং চাপমুক্ত বিকল্প হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ইতোমধ্যে জিএস পদের প্রার্থী বাকেরকে সমর্থন জানিয়ে প্রার্থিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মাহিন সরকার। শেষ মুহূর্তে তারা আরও কিছু নতুন কৌশল কাজে লাগাতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদের বলেন, জুলাই আন্দোলনে গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতির অবসান ঘটে গেছে। এটা নিয়ে আর কারও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কিছু নেই। আমরা জীবন দিয়ে হলেও হল ও ক্যাম্পাসের বর্তমান এ পরিবেশ রক্ষা করব।

বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’

ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ এবারের নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের মতে, ছাত্রদল ও কাদের-বাকেরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’।

এই প্যানেলের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদ বলেন, গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি ছাত্রদল তৈরি করেছিল, পরে ছাত্রলীগ তা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। শিক্ষার্থীরা গত জুলাই আন্দোলনে এই সংস্কৃতির কবর রচনা করেছে। নতুন করে বিলুপ্ত করার কিছু নেই। আমরা নিশ্চিত করছি, ভবিষ্যতে এমন সংস্কৃতি কেউ আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না।

বিশ্লেষকদের মতে, শিবিরের শক্তি সাধারণ অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী ও নারী শিক্ষার্থীরা। শৃঙ্খলাবদ্ধ সাংগঠনিক কাঠামোও তাদের জন্য সুবিধা হিসেবে কাজ করছে।

ঐক্যবদ্ধ থাকতে চেয়েও বিভক্ত বাম

বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো। তাদের তিনটি পৃথক প্যানেল ভোটের মাঠে রয়েছে– ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ ও ‘ইউনিটি টু রিবিল্ড’। ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ থেকে ভিপি পদে প্রার্থী হয়েছেন শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি। যাকে নিয়ে বামদের মধ্যে মূল বিভেদ।

ইমিকে ভিপি প্রার্থী করায় ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্রভাবে গবেষণা ও প্রকাশনা পদে লড়ছেন ছাত্র গণমঞ্চের আরাফাত ইমরান।

প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলের এজিএস প্রার্থী বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর জাবির আহমেদ জুবেল বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি বাম-প্রগতিশীল সব সংগঠনের সঙ্গে এক হয়ে ভোটে অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থে এক হতে চায়নি।

‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী নাইম হাসান হৃদয় মনে করেন, বিভাজন অবশ্যই ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে।

এদিকে, ছাত্র ফেডারেশন সমর্থিত ‘ইউনিটি টু রিবিল্ড’ ভিপি ও জিএস পদে প্রার্থীই দেয়নি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের বিভাজিত বামপন্থি প্যানেলগুলো নির্দিষ্ট কিছু পদে প্রভাব ফেললেও বড় পদে তাদের জয়ের সম্ভাবনা কম।

লড়াইয়ে আছেন অভ্যুত্থানের নারী মুখ উমামা ফাতেমা

‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ নামের একটি প্যানেলও এবারের ডাকসু নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক আহ্বায়ক উমামা ফাতেমা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ আল সাদী ভূঁইয়া এ প্যানেল থেকে ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচন করছেন। 

এই প্যানেলের প্রার্থীরা রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত থেকে স্বতন্ত্রভাবে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন। তবে তাদের সাংগঠনিক শক্তি তুলনামূলক দুর্বল। বিশ্লেষকরা বলছেন, নারী শিক্ষার্থীদের ভোটের কারণে ভিপি পদের ইকুয়েশন চলে যেতে পারে উমামার দিকে।

ভোটারদের মধ্যে মিশ্র মনোভাব দেখা গেছে। একদিকে ছাত্রদলের তরুণ শক্তি, পূর্ণাঙ্গ প্যানেল এবং ঐতিহ্য তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে অভ্যুত্থানের নতুন প্রজন্ম ও নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। ইসলামী ছাত্রশিবিরও শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শক্তিশালী উপস্থিতির মাধ্যমে নির্বাচনে নিজেদের অবস্থানের জানান দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের ডাকসু নির্বাচন শুধু নেতৃত্ব নির্বাচন করবে না, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎও নির্দেশ করবে। কে জয়ী হবে তা নির্ধারণ করবে ভোটারদের আকাঙ্ক্ষা, সংগঠনগুলোর কার্যক্রম, অতীত ইতিহাস ও নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডাকসু নির্বাচন শুধু বিজয়ী প্যানেলগুলো থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্ধারণ করবে না, বরং তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা, শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও ক্ষমতার ভারসাম্য কেমন হবে তা নির্ধারণ করবে। নতুন প্রজন্মের ছাত্রসংগঠনগুলো কীভাবে সুশৃঙ্খলভাবে এবং শিক্ষার্থীদের কল্যাণে দায়িত্ব পালন করবে সেটিও নির্ধারণ করবে।

তিনি বলেন, এবার ডাকসু হবে এক্সক্লুসিভ। এককভাবে প্যানেল ধরে কেউ জয়ী হতে পারবে না। এদিক থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চমক দেখিয়ে জয় ছিনিয়ে নিতে পারেন।

কী বলছেন শিক্ষার্থীরা

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান বলেন, আমরা এমন একটা ডাকসু চাই, যেটা শুধু ছাত্রদের অধিকারের জন্য কাজ করবে, কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করবে না। জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা এটাই দেখেছি যে সাধারণ শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে কীভাবে একটা বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেই স্পিরিটটা ধরে রেখেছে। তাদের কোনো পুরোনো রাজনৈতিক দায় নেই, তাই তারা শিক্ষার্থীদের জন্য স্বচ্ছভাবে কাজ করতে পারবে বলে আমার মনে হয়।

সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী নোমান বিন ফারুক বলেন, বামপন্থি প্যানেলগুলো বিভক্ত হওয়ায় আমি হতাশ। তারা যদি একত্রিত হয়ে নির্বাচন করত তবে হয়ত একটি শক্তিশালী তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারত। তাদের ইশতেহারে অনেক ভালো দিক থাকে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর। স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও ভালো কিন্তু তাদের সাংগঠনিক শক্তি কম হওয়ায় তারা হয়ত তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।

আরবি ও ভাষা সাহিত্য বিভাগের ২০২৩-২৪ সেশনের শিক্ষার্থী নওশাদ বলেন, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘গণরুম’ ও ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতির বিলুপ্তি। জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা যে মুক্ত বাতাস পেয়েছি তা কোনোভাবেই হারাতে চাই না। যে প্যানেলই জিতুক না কেন, তাদের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। এদিক থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এগিয়ে আছে বলে আমার মনে হয়।

দর্শন বিভাগের ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী সমাপ্তি খাতুন বলেন, আমি একজন নারী শিক্ষার্থী হিসেবে ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ও একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। অতীতে ছাত্ররাজনীতিতে অনেক সহিংসতা দেখেছি, বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। শামসুন্নাহার হলের ঘটনা এখনো আমাদের মনে আছে। তাই যে প্যানেল এই বিষয়গুলোতে প্রতিশ্রুতি দেবে তাদের প্রতি আমাদের আস্থা থাকবে। শিবির ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এদিক থেকে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।