বিতর্কিত অজিতকে সিইও নিয়োগ দিচ্ছে যমুনা লাইফ!

Rashedul Hoque
বাংলাবাজার রিপোর্ট
প্রকাশিত: ৬:৪১ অপরাহ্ন, ২৬ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১০:০২ অপরাহ্ন, ২৬ অক্টোবর ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত



বীমা খাতের একের পর এক প্রতিষ্ঠানে আইন লংঘন, অনিয়ম-দুর্নীতি, জালিয়াতি, দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড ও আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থেকে এক ভয়াবহ বিতর্কিত চরিত্রে পরিণত হয়েছেন অজিত চন্দ্র আইচ। আর সেই বিতর্কিত অজিতকেই সিইও নিয়োগ দিচ্ছেন যমুনা লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানী! এই নিয়োগের পেছনে রয়েছে যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের দীর্ঘদিনের অনিয়ম-অপরাধ চলমান রাখার গভীর ষড়যন্ত্র। পরিচালনা পর্যদের একটি অংশ বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-এর মতামতকে পাশ কাটিয়ে এই বিতর্কিত অজিতকে নিয়োগের নীল নকশা করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি এর আগেও একাধীকবার বীমা আইন লঙ্ঘন করে আইডিআরএ’র দ্বারা জরিমানার সন্মুখিন হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ন্যাশনাল লাইফ, সন্ধানী, প্রগ্রেসিভ, থেকে শুরু করে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি—প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তার উপস্থিতিই যেন ছিল বিশৃঙ্খলার প্রতীক। তবুও আশ্চর্যের বিষয়, এতসব অনিয়ম ও অপরাধের পরেও তিনি এখন আবারও বীমা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হওয়ার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি আইডিআরএ।

সূত্র জানায়, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডে অজিত চন্দ্র আইচের মেয়াদকালে সংঘটিত হয় ৩৪৯.০৮ কোটি টাকার ভয়াবহ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ইতোমধ্যে এই অনিয়মের বিস্তারিত অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন আকারে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) নিকট প্রেরণ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা আত্মসাৎ করেন। আত্মসাৎ চলাকালীন দীর্ঘ সময় সোনালীর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অজিত চন্দ্র আইচ প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন।

অজিতের অপরাধের ইতিহাস কিন্তু নতুন নয়। ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সে আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে গভীর রাতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে মতিঝিল থানায় নিয়ে যায়—এমন ঘটনাও রেকর্ডে আছে।

এছাড়াও ২০২০ সালের দিকে প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সে যোগদান করেন তিনি, কিন্তু কর্মজীবনে ব্যর্থতার কারণে দীর্ঘদিন ছুটিতে থেকে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তার এই অদক্ষতা ও নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে একটি সংঘবদ্ধ চক্র কোম্পানির ভেতরে গভীর ষড়যন্ত্র চালিয়ে প্রোগ্রেসিভে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সাধন করে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, প্রগ্রেসিভ লাইফের পতনের জন্য অজিতের দুর্বল নেতৃত্ব ও দায়িত্বহীনতাই মূলত দায়ী।

এর আগে সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে থাকাকালীন একই ধরণের অনিয়ম ও জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে অজিত চন্দ্রের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে নিজস্ব স্বাক্ষরে বিভিন্ন অনুমোদন ও আর্থিক সুবিধা প্রদান করেছেন, যা অফিসের নিয়ম-বিধির চরম লঙ্ঘন। ভুয়া ছাড়পত্র, যোগ্যতা না থাকা কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার এবং প্রশাসনিক কারচুপিসহ নানা দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে তার সময়কালে। এসব অনিয়মের মাধ্যমে তিনি কেবল নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন না- বীমা খাতকেও করেছেন গভীরভাবে কলুষিত।

সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রধান নির্বাহী ছিলেন অজিত চন্দ্র আইচ। তাঁর সময়ে কোম্পানির বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করা হয়, যা বিভিন্ন খাতে ব্যয় দেখিয়ে আত্মসাৎ করে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। প্রতিটি লেনদেনেই মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে অজিতের অনুমোদন বা সহযোগিতা ছিল।

তদন্তকারী সংস্থা বলছে, পরিচালনা পর্ষদ এককভাবে এত বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করতে পারত না যদি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সহযোগিতা না করতেন। ফলে অজিত চন্দ্র আইচ এই অর্থ আত্মসাতের দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বীমা আইনের ৫০(১) ধারা অনুযায়ী গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুন্ন করার দায়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা থাকলেও, বিস্ময়করভাবে এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং তাকে বীমা কোম্পানির সিইও “পুলে” অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েও গভীর প্রশ্ন তুলেছে।

বীমা খাতের অনেকেই বলছেন, যে খাতে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা ছিল, সেখানে অজিত চন্দ্র আইচের মতো কর্মকর্তাদের অপরাধ-অনিয়ম বীমা শিল্পের প্রতি জনআস্থা ধ্বংস করছে। তার মতো অপরাধীদের যদি বারবার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে পুরো খাতই ধ্বংসের পথে যাবে। এখন প্রয়োজন—অজিত চন্দ্র আইচসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা, যাতে ভবিষ্যতে কোনো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা তার পদমর্যাদা ব্যবহার করে এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য অজিত চন্দ্র আইচের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও, তিনি কলটি ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

অন্যদিকে, অতীত থেকেই আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত যমুনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অব্যবস্থাপনা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। কোম্পানির একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি, ভুয়া বিল তৈরি এবং ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে কোম্পানিকে দেউলিয়া অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্তে দেখা গেছে, সরকারি কোষাগারে ভ্যাট ও ট্যাক্স জমা না দেওয়ায় অডিটে দুই কোটি টাকা জরিমানা হয়, যার মধ্যে ঘুষের নামে এক কোটি টাকা তোলা হয়। কোম্পানির বিভিন্ন ক্যাশ অফিস থেকেও কোটি কোটি টাকা তুলে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা। চট্টগ্রামে এফডিআর কেলেংকারীরও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

এছাড়া গ্রুপ বিমা, বিশ্ববিদ্যালয় চুক্তি, পরিবহন খরচ, বার্ষিক সম্মেলনসহ নানা খাতে ভুয়া বিল ও অতিরিক্ত ব্যয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এর ফলে কোম্পানির লাইফ ফান্ড নেমে এসেছে ঋণাত্মক অবস্থায়, প্রিমিয়াম আদায় কমে গেছে, নবায়ন হার কমে দাঁড়িয়েছে ১১ শতাংশে, আর সম্পদও ক্রমাগত কমছে।

আইডিআরএ’র তদন্তে দেখা যায়, যমুনা লাইফ ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, যার ফলে ২০২১ সালে লাইফ ফান্ড ঋণাত্মক ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে কোম্পানিটি বিমা গ্রাহকদের দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলে সতর্ক করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

তদন্ত প্রতিবেদনে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদি, নবায়ন প্রিমিয়াম কমে যাওয়া, সম্পদ বিনিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগের ভিত্তিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, কমিশন ব্যয় হ্রাস ও বিশেষ নিরীক্ষার সুপারিশ করা হয়েছে। কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি নাজুক হয়ে পড়ায় গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় আইডিআরএকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে খাত সংশ্লিষ্টরা।