সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বঞ্চিত গরিবরা

চামড়ার দাম ছিল কাগজে-কলমে

Any Akter
দেলোয়ার হোসেন মহিন
প্রকাশিত: ৩:০৫ অপরাহ্ন, ২০ জুন ২০২৪ | আপডেট: ১:৫২ অপরাহ্ন, ১৪ অগাস্ট ২০২৫
ছবিঃ সংগৃহীত
ছবিঃ সংগৃহীত

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। ট্যানারি মালিকসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে দাম নির্ধারণ করা হলেও বাজারে এর কোনো প্রতিফলন নেই। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকারি বিভিন্ন সংস্থা হুঙ্কার দিলেও ঈদের দিনে কোনো প্রতিষ্ঠানকে মাঠে পাওয়া যায়নি। এ সুযোগে আড়তদাররা ইচ্ছেমতো দামে চামড়া কিনেছেন খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম গত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৫৫-৬০ টাকা বর্গফুট আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ সাত টাকা বাড়িয়ে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

আরও পড়ুন: পাম অয়েলের দাম লিটারে কমলো ১৯ টাকা

চলতি বছর গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণের সময় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, দাম নির্ধারণে ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২০ বর্গফুট হয় বলে হিসাব করে মূল্য ঠিক করা হয়েছে। ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে ১১০০-১২০০ টাকা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। পোস্তায় এক লাখ টাকা দামের গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। যদিও বেপারীরা কাঁচা চামড়া বলে অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু একটি চামড়ায় ১০০ টাকার লবণ লাগে। শুধু এক লাখ টাকা নয়, দেড় লাখ টাকা গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৫০ টাকায়। এছাড়া লাখ টাকা গরুর চামড়া ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ কম। পোস্তায় প্রতিটি গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৯০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে আর ছাগলের চামড়া ১০ টাকায়।

গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যারা কোরবানি দিয়েছেন তারা কাঁচা চামড়া বিক্রির লোক খুঁজে পাচ্ছেন না। যারা বিক্রি করতে পেরেছেন তারাও নামমাত্র দাম পেয়েছেন। আবার অনেকে কাঙ্ক্ষিত দাম ও ক্রেতা না পেয়ে মাদরাসা ও এতিমখানার লোকজনকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিচ্ছেন। রাজধানীর জিগাতলা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আউয়াল বাংলাবাজারকে বলেন, ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ৫৫০ টাকায়। গত কয়েক বছর ধরে কম দামেই চামড়া বিক্রি করছি। আগামীতে মাদরাসায় দান করে দেব।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত

কামরাঙ্গীরচরে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার গরু কোরবানি দিয়েছেন মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করেছে যদি এই দামে চামড়া বিক্রি করা যেত, তাহলে আমার কোরবানির গরুর চামড়ার দাম কম হলেও ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা হতো। কিন্তু দাম বলেছে মাত্র ৪০০-৪৫০ টাকা। তাই বিক্রি না করে এলাকার এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছি।

আড়তদার বলছেন, গত এক দশকের বেশি সময় ধরে সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও এ দামে চামড়া কেনেন না তারা। এক লাখ টাকার গরুর কাঁচা চামড়া এলাকাভেদে সর্বোচ্চ ৬০০-৭০০ টাকা বিক্রি হয়।

কয়েকজন আড়তদার বলছেন, এক যুগ আগে যে চামড়ার দাম ২০০০ বা ২২০০ টাকা ছিল সেটি এখন ৭০০ টাকা। এর মূল কারণ একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে চামড়ার বাজারের নিয়ন্ত্রণ। ফলে তারা যে দামে ঠিক করে দিচ্ছে এর বাইরে চামড়া কেনার সুযোগ নেই কারও।

এর প্রমাণ মিললো গতকাল এক মৌসুমি বিক্রেতার কাছে। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুল হক বলেন, মোট ২৫০টি কাঁচা চামড়া কিনে বিক্রি করেছি। বলতে গেলে চামড়ার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। আড়ত থেকে আমাদের সংকেত দেওয়া হয়েছে গরুর দাম যতই হোক ৮০০ টাকার বেশি দামে যেন চামড়া না কিনি। পোস্তা আড়তদার মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জানিয়েছেন ৭০০-৮০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনবেন না। তাই আমরা গড়ে একটা চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেছি। প্রতি চামড়ায় এক দেড়শ টাকা খরচ আছে। এরপরও বিক্রি করছি। লাভ থাকবে কি না জানি না।

মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছর ট্যানারি মালিকদের চামড়ার চাহিদা একটু কম। কারণ ট্যানারিতে পুরাতন চামড়ার মজুত থাকায় গত কয়েক বছর ধরে কাঁচা চামড়ার চাহিদা ছিল খুবই কম। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিন, ইসরাইল যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ফলে, বিশ্বজুড়ে চামড়াজাত পণ্য ও চামড়াজাত জুতার মতো বিলাসবহুল পণ্যের দাম ও চাহিদা দুটোই কমেছে। চাহিদা ও দাম কমার এ প্রবণতা বাংলাদেশের কাঁচা চামড়ার বাজারে প্রভাব ফেলেছে। ফলে দেশের বাজারে চামড়ার দাম কমেছে।

হুঙ্কার দিয়েও মাঠে ছিল না তদারকি সংস্থা

চামড়া নিয়ে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পুলিশ, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ঢাকা সিটি কপোরেশনসহ বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থা। সারাদিন সরকারের বেঁধে দেওয়ার দামের চেয়ে পাঁচগুণ কমে দামে চামড়া বেচা-বিক্রি হলেও এসব সংস্থার কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।

জানা গেছে, কোরবানির চামড়া সংরক্ষণ ও তদারকিতে পাঁচটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকি করতে থাকে কেন্দ্রীয় কমিটি। এছাড়া বিভাগীয় কমিটি, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনা কমিটি, সার্বক্ষণিক তদারকির জন্য কমিটি ও জেলা কমিটি করা রয়েছে।

এসব কমিটি মূলত কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ক্রয়-বিক্রয় ও পরিবহনসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা তদারকির করে। সচিবের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি কাজ করে। এছাড়াও একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে আট সদস্যের বিভাগীয় কমিটি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আইআইটি অনুবিভাগের একজন উপ-সচিবের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ দায়িত্ব পালন করেন। ১১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল সেল, ২৯ জন সদস্য নিয়ে জেলা কমিটি থাকলেও বাজার মনিটরিংয়ে তাদের কোনো কার্যক্রম দেখেননি ব্যবসায়ীরা।

লালবাগের পোস্তায় আড়তদার মোখলেস উদ্দিন এসব কমিটির বিষয়ে জানেন না দাবি করে বলেন, সারাদিন কোনো সরকারি লোক এসে একবার জিজ্ঞেস করল না আমরা কেন কম দামে চামড়া কিনছি। 

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতার উদ্দিন বাংলাবাজারকে বলেন, লবণ ও মৌসুমি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার কারণে এবার সরকারের নির্ধারিত দামে চামড়া কেনা সম্ভব হয়নি। তবে ঢাকার বাইরে চামড়াগুলো গতকাল রাজধানীতে এসেছে। তারা কাঁচা চামড়ার দাম একটু বেশি পেয়েছে। 

বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএইচএসএমএ) মহাসচিব টিপু সুলতান বাংলাবাজারকে বলেন, চামড়ার দাম সরকার নির্ধারণ করলেও বাজারের বাস্তবতা আসলে অন্য। গত বছরের তুলনায় এবার চামড়ার দাম তুলনামূলক ভালো ছিল। সরকার লবণসহ চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ী ও

আড়তদাররা কাঁচা চামড়া কিনেছেন। ওই দামের সঙ্গে মেলালে হবে না। কারণ একটা কাঁচা চামড়ায় আরও ২০০ থেকে ২৫০ টাকার লবণ মেশাতে হয়।

চামড়া সিন্ডিকেটের বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বাংলাবাজারকে বলেন, সরকার লোক দেখানো চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু এ দামেও কেউ চামড়া ক্রয় না করে পাটের মতো চামড়াকেও ধ্বংসের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে। তিনি বলেন, কোরবানির চামড়ার বাজারে এবারও দরপতন। লাখ টাকার গরুর চামড়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। সেখানে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চামড়ার ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কোরবানির চামড়ার ভয়াবহ দরপতন হচ্ছে। সরকার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে পাট শিল্পের মতো চামড়া শিল্পকেও ধ্বংসে কাজ করছে। এতে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এতিম, অসহায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়ল। তিনি আরও বলেন, অপরদিকে কওমি মাদরাসা যা সরকারের কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই দেশের শিক্ষাখাতে অসামান্য অবদান রাখছে, সে কওমি মাদরাসাগুলোকে ধ্বংসের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে কাজ চলছে।

অন্যদিকে কাঁচা গরুর চামড়া নিয়ে পোস্তগোলায় আসেন মাদ্রাসার শিক্ষকরা। তাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের দাবি, বড় ও মাঝারিসহ সব গরুর চামড়ার পিস গড়ে ৩০০ টাকার বেশি কেউ দর দিচ্ছে না। রাজধানী ঘুরে দেখা যায়, বর্গফুটে নয়, চামড়া বিক্রি হচ্ছে পিস হিসেবে। এখানে সবচেয়ে বড় চামড়া ৩০০-৫০০ টাকা পিস ধরে এবং সবচেয়ে ছোট গরুর চামড়া ২০০ টাকা পিস ধরে বিক্রি হচ্ছে। খাসি ও ছাগলের চামড়ার কোনো দামই নেই। অন্যদিকে শাহাদাত হোসেন নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী ১২০টি চামড়া নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, গরুর চামড়ার কোনো দাম নেই। একটি জুতার দাম হাজার টাকা হলেও গরুর চামড়ার দাম মাত্র ৩০০ টাকা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, সব সিন্ডিকেট করে চামড়ার দর কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক চামড়া বিক্রেতাই বলছেন, এই দর থাকলে তাদের পথে বসতে হবে।