বাংলাদেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নদী

"নদীমাতৃক বাংলাদেশ"—শুধু একটি বাক্য নয়, বরং দেশের ভূপ্রকৃতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবনের এক চিরন্তন বাস্তবতা। প্রায় ৭০০টির বেশি নদী প্রবাহিত হলেও কিছু নদী রয়েছে যেগুলো দেশের ইতিহাস, পরিবেশ এবং উন্নয়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। চলুন জেনে নিই এমন ১০টি গুরুত্বপূর্ণ নদীর পরিচয় ও অবদান এক নজরে।
১. পদ্মা নদী
আরও পড়ুন: শাহরুখ খানের ফিটনেসের রহস্য জানালেন বিশেষজ্ঞ
পদ্মা নদী বাংলাদেশের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী, ভারতের গঙ্গা নদীর একটি প্রধান শাখা। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কাছাকাছি গঙ্গা ভাগ হয়ে পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। চাঁদপুরে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। নদীর পলিমাটি অত্যন্ত উর্বর, যা কৃষিতে অবদান রাখে। তবে ভূমিক্ষয় ও নদী ভাঙন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বহু সাহিত্যে এবং লোককথায় পদ্মা নদীর উল্লেখ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়ও পদ্মার রূপ ও রহস্য ধরা পড়েছে।
২. যমুনা নদী
আরও পড়ুন: আজ বিশ্ব ডাক দিবস
যমুনা নদী হলো ব্রহ্মপুত্রের বাংলাদেশ অংশের প্রধান শাখা। ভারতের আসাম রাজ্যে উৎপত্তি হয়ে এটি তামসা নদী নামে পরিচিত ছিল। জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া ইত্যাদি জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আরিচায় পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। যমুনা বহুমুখী সেতু (বঙ্গবন্ধু সেতু) দেশের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলকে যুক্ত করেছে। নদীপথে পণ্য পরিবহন সহজ হয়েছে। স্রোত অত্যন্ত প্রবল; ফলে নৌচলাচল বিপজ্জনক হয় অনেক সময়। ঘন ঘন চর গঠন ও নদীভাঙন ঘটে।
৩. মেঘনা নদী
মেঘনা বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও গভীরতম নদী। এটি ভারতের বরাক নদীর দুটি শাখা (সুরমা ও কুশিয়ারা) একত্র হয়ে গঠিত। কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল—এইসব অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ। চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভোলার নদীবন্দরগুলো এ নদীর ওপর নির্ভরশীল। বিশাল মৎস্য সম্পদের উৎস। ভাটার টান প্রবল, নদীর গভীরতা অনেক বেশি, ফলে বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের প্রবণতা বেশি।
৪. ব্রহ্মপুত্র নদী
ব্রহ্মপুত্র ভারতের তিব্বত অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং যমুনা নামে পরিচিত হয়। হিমালয় থেকে নেমে আসা একটি বৃহৎ নদী হওয়ায় প্রচুর পলি বহন করে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিক্ষেত্রে অবদান রাখে। কুরিগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলা। পলি জমার ফলে নতুন চরের সৃষ্টি হয়। তবে বর্ষায় নদীভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
৫. কর্ণফুলী নদী
চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান নদী। এটি ভারতের মিজোরাম থেকে উৎপত্তি হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দিয়ে প্রবাহিত হয়। কর্ণফুলী নদীর তীরে চট্টগ্রাম বন্দর, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। কর্ণফুলী পেপার মিলসহ বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান এর ওপর নির্ভরশীল। কাপ্তাই বাঁধ এবং কাপ্তাই হ্রদ কর্ণফুলী নদীর জলাধার থেকে সৃষ্ট, যা দেশের প্রথম ও একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নদী দখল ও দুষণের ফলে জলের মান ও নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে।
৬. তিস্তা নদী
তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এখনো সম্পাদিত হয়নি। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে আসে। পলি জমার ফলে কৃষিজমি উর্বর হয়। তবে বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
৭. সুরমা নদী
ভারতের মেঘালয় থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়। সিলেট অঞ্চলের ধান ও চা চাষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হাওর অঞ্চলের পানির প্রধান উৎস। বর্ষায় হাওর প্লাবিত হলে এই নদী জীবনরক্ষাকারী হিসেবে কাজ করে।
৮. কুশিয়ারা নদী
সুরমা নদীর শাখা নদী হিসেবে কুশিয়ারা জন্ম নেয় এবং সিলেট, মৌলভীবাজার অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়। হাওরের পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে এটি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিতে সেচ, মাছ ধরা ও নৌচলাচলে ব্যবহৃত হয়। দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল হাওর এই নদীর উপর নির্ভরশীল।
৯. আড়িয়াল খাঁ নদী
মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল অঞ্চলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত একটি ঐতিহাসিক নদী। স্থানীয় কৃষি ও পরিবহনে অত্যন্ত কার্যকরী। বরিশালের কিছু অঞ্চলে নৌপথে পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম। নদীর গভীরতা হ্রাস, দখল ও দূষণ বর্তমানে বড় হুমকি।
১০. ইছামতি নদী
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী নদী। এটি সাতক্ষীরা ও যশোর অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঔপনিবেশিক আমলে এটি ব্যবসা ও সীমানা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখনো সীমান্ত রক্ষা ও আঞ্চলিক যোগাযোগে ব্যবহৃত হয়। দূষণ, শিল্প বর্জ্য ও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণের কারণে নদীটির স্বাভাবিক প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশের নদীগুলোর সাথে এ দেশের মানুষ, মাটি, সংস্কৃতি ও অস্তিত্বের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। নদীগুলো শুধু প্রাকৃতিক সম্পদ নয়, এগুলো আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ। সঠিক নদী ব্যবস্থাপনা, পানির সুষম বণ্টন, দূষণ রোধ এবং নদী রক্ষা আইন প্রয়োগ ছাড়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই নদীগুলো টিকে থাকবে না। নদী সংরক্ষণ এখন আর শুধু পরিবেশবাদীদের কাজ নয়, এটি প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব।