এনবিআরের ৪ কর্মকর্তা বাধ্যতামূলক অবসরে, বরখাস্ত কমিশনার
রাজস্ব প্রশাসনে চাপা ক্ষোভ আতঙ্কে অস্থিরতার শঙ্কা

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরে আন্দোলনকারী নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা নিচ্ছে সরকার। আন্দোলন প্রত্যাহার করে রাজস্ব কর্মকর্তারা কাজে ফিরলেও সরকারি অ্যাকশনে চাপা ক্ষোভ ও আতঙ্কে নতুন করে অস্থিরতার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনারকে মধ্যরাতে বরখাস্ত ও ৩ সদস্য সহ চার উর্ধতন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার।
বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কর্মকর্তারা হলেন—কাস্টমস শুল্কনীতির সদস্য হোসেন আহমদ, ভ্যাটনীতির সদস্য ড. আব্দুর রউফ, আয়কর বিভাগের সদস্য আলমগীর হোসেন এবং কর কমিশনার শাব্বির আহমদ।
আরও পড়ুন: ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
বুধবার (২ জুলাই) অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) এ সংক্রান্ত পৃথক আদেশ জারি করেছে বলে নিশ্চিত করেছে একটি দায়িত্বশীল সূত্র।
আন্দোলন কমিটির আহবায়ক সদস্য সচিবসহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ১১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধি ও রাজস্ব আদায়ের মুখ্য ভূমিকা পালনকারী এনবিআরের সংস্কার নিয়ে গত দুই মাস ধরে আন্দোলন করছিল এনবিআরএম কাস্টমস ও ইনকাম ট্যাক্সের কর্মকর্তা কর্মচারীরা। রাজত্ব সংস্কার কমিটির নামে সর্বশেষ চূড়ান্ত পর্যায়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে দেশের আমদানির রফতানি তোতার আদর্শ সদায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়েছিল। সরকারের কঠোর মনোভাব ও মধ্যস্থতাকারী ব্যবসায়ী কমিটির সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে আন্দোলন প্রত্যাহার করে কর্মচারীরা কাজে যোগদান করে।
আরও পড়ুন: আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে বিদেশ যেতে দেয়া হয়নি
বর্তমান চেয়ারম্যান প্রত্যাহারে এক দফা দাবি থাকলেও কর্মচারীরা আন্দোলন প্রত্যাহার করে চেয়ারম্যানের সাথে বৈঠক করে। এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান প্রথম দিনেই পেছনের সব ভুলে নতুন করে কাজে যোগদানে ধন্যবাদ জানান এবং কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার স্বাক্ষরেই চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার জাকির হোসেনকে মধ্যরাতে বরখাস্ত করা হয়েছে। অপরদিকে আন্দোলনরত কর্মচারী ১১ নেতার বিরুদ্ধে উদ্যোগে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এছাড়াও কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদন্ত শুরু করেছে।
রাজস্ব বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সরকারের অত্যাবশ্যকীয় এই বিভাগে অস্থিরতা তৈরি করলে জাতীয় অর্থনীতির রাজস্বের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অস্থিরতার বদলে আলোচনার মাধ্যমে সবাইকে আস্তায় এনে কাজ করতে হবে। সরকারের গঠিত উপদেষ্টা কমিটিকে সর্বাগ্রে এ বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দিলেও স্বাভাবিক পরিবেশ হয়নি এনবিআরে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার দায়ে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) মো. জাকির হোসেন।
গত মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন ২১ জুন ও ২৮ জুন তারিখে কর্মস্থলে উপস্থিত হননি। অথচ এর আগে ১৮ জুন ২০২৫ তারিখে এনবিআর-এর এক আদেশে ২৮ জুনের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেই নির্দেশ অমান্য করায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটেছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে সরকারি চাকরি (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৮ এর ধারা ৩৯(১) অনুযায়ী তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাকে আগামী ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে এই ব্যাখ্যা দাখিল করতে বলা হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, কাস্টমসে সবচেয়ে সৎ দক্ষ ও দেশ প্রেমিক কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন। আন্দোলনে পরিস্থিতি বিবেচনায় সারা দেশের মতো তিনি কাজে বিরত থাকেন। আলোচনার প্রেক্ষিতে আন্দোলন প্রত্যাহার ও সমাধানের জন্য উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর এধরনের শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থা উদ্দেশ্যমূলক এবং উস্কানিমূলক দেখছেন অনেকেই। তারপর বরখাস্তের পর কাস্টম ও ট্যাক্সের অন্যান্য কর্মকর্তারা আছেন আতঙ্কে।
বরখাস্ত বদলি আতঙ্ক ছাড়াও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আতঙ্ক বিরাজ করছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। গত রবিবার এনবিআরের ছয় কর্মকর্তার পর মঙ্গলবার আরো পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর কথা জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি। এনবিআরের আরও কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর আদায়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলছে তাদের অধিকাংশই এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেড় মাস ধরে তারা এনবিআর সংস্কারের পাশাপাশি এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন। সে আন্দোলনের কারণে দুদক তদন্ত করছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে। জানতে চাইলে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের মহাসচিব বলেন, দুদকের তদন্তের সঙ্গে আন্দোলনের অবশ্যই একটা সম্পর্ক রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, এটা আগে থেকেই নিশ্চয়ই হয়ে আসছিল। এখন কেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে? এনবিআরের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বিধায় তাদের হয়রানি করার জন্য দুদক তদন্তের কথা বলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ ছাড়া দুদকের তদন্তের ভয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়নি বরং ব্যবসায়ীদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তা করা হয়েছে বলে জানান পরিষদের মহাসচিব সাহেলা। । এনবিআর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্তে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দুদকের কার্যক্রমে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
এদিকে গত মঙ্গলবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআরের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর আদায়ে ঘুস গ্রহণ, কর ফাঁকির সুযোগ দেওয়া ও হয়রানির অভিযোগে তদন্তের কথা জানিয়েছে দুদক। তারা হলেন এনবিআরের সদস্য লুৎফুল আজীম, ভ্যাটের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) অতিরিক্ত কমিশনার আবদুর রশীদ মিয়া, কর গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, কর অঞ্চল-১৬-এর উপ-করকমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও এনবিআরের যুগ্ম কমিশনার তারেক হাসান। গত রবিবার ছয়জনের বিরুদ্ধে তদন্ত অনুসন্ধানের কথা জানায় দুদক।
তারা হলেন আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য একেএম বদিউল আলম; নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার; ঢাকা-৮ কর-অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা; ঢাকা কর অঞ্চল-১৬-এর অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা; ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কুণ্ডু এবং বিএসএস কর একাডেমির যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান। দায়িত্ব পালনকালে এসব কর্মকর্তা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কর ও শুল্ক ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন বলে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে কিছু করদাতাকে কর ফাঁকির সুযোগ করে দেওয়া, আবার নির্ধারিত পরিমাণ কর আদায় না করে ইচ্ছাকৃতভাবে কর কমিয়ে দিয়ে করদাতা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উভয়ে লাভবান হওয়া, ঘুস না পেলে কর ফাঁকির মিথ্যা মামলা দিয়ে করদাতা ও প্রতিষ্ঠানের মালিকদের হয়রানি করাসহ বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।