৫ আগস্ট ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে’ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা

৫ আগস্ট ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, সংবিধানের তপশিলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ যুক্ত করা হবে এবং আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) সন্ধ্যায় দেওয়া এই ভাষণে তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সরকারের অর্জন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন।
ড. ইউনূস তার ভাষণের শুরুতে গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং আহতদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এক বছর আগে এই দিনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পূর্ণতা পায়, দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্ত হয় প্রিয় স্বদেশ।”
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত এক বছরে সরকার বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সচল করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি জানান, মাত্র এক বছরের মধ্যে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পালা। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনা সফলভাবে সমাপ্ত হওয়া এবং এর ফলে অর্থনীতির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ছিল সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং জুন মাসে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৮.৪৮ শতাংশ হয়েছে, যা বিগত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রবাসীদের আস্থার ফলে গত অর্থবছরে রেকর্ড তিন হাজার ৩৩ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে এসেছে এবং রপ্তানি আয়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
আরও পড়ুন: আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বড় চ্যালেঞ্জ: সিইসি
ড. ইউনূস তার ভাষণে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংস্কারকৃত সংবিধানের তপশিলে এই ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত থাকবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পথে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন। এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, বৃহত্তর পরিমণ্ডলের রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।"
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকারের তিনটি প্রধান দায়িত্ব ছিল: সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। তিনি জানান, জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে এবং আনুষ্ঠানিক শুনানিও শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, "এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান।" এই ভাষণের পর থেকেই একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে তিনি জানান। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠি পাঠাবেন যেন আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
ড. ইউনূস ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেন, “এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে।” তিনি প্রবাসী ও নারী ভোটারদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।
ড. ইউনূস তার ভাষণে বিভিন্ন খাতের সংস্কার কার্যক্রম তুলে ধরেন:
অর্থনীতি: ‘পানিভিত্তিক অর্থনীতি’ গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, নদী ও সমুদ্রকে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকীকরণ ও গভীর সমুদ্রকে ঘিরে মৎস্য আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করেন।
আইন ও বিচার: তিনি জানান, ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন অধ্যাদেশ, ২০২৫ অনুমোদন করা হয়েছে, যা আটককৃত ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করবে।
আইনশৃঙ্খলা: পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণে জাতিসংঘের স্বীকৃত পাঁচটি ধাপ অনুসরণ করা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে বিভিন্ন সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে ‘সেল’ স্থাপন করার কথা তিনি জানান।
গণমাধ্যম: তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হয়েছে এবং নতুন আইনে নিবর্তনমূলক ৯টি ধারা বাদ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের গ্রেড বৃদ্ধি, ই-লার্নিং চালু এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার প্রতিশ্রুতি দেন।
বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রবাস: বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা জটিলতা কমানো, দক্ষ কর্মীদের বিদেশে পাঠানো এবং বিদেশে বসবাসরত প্রবাসীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার কথা তিনি বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণের শেষে সকল নাগরিককে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রথম বড় পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান।