পুলিশ সুপারের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক, কিছুই জানেন না স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

‘আপা আর আসবে না, কাকা আর হাসবে না’ চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের এই বক্তব্য নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের আনুগত্য পাওয়ার পুরনো চেষ্টারই পুনরাবৃত্তি বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। এছাড়া একজন সরকারি চাকরিজীবী এভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে পারেন কিনা এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে।
এই বক্তব্য নিয়ে নানা মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চললেও এ বিষয়ে এখনো ‘কিছুই জানেন না’ বলে দাবি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার। বুধবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন।
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি
তবে, ‘সরকারি কর্মচারীর এমন বক্তব্য আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন, ক্লিয়ার ভায়োলেশন অব কোড অব কনডাক্ট,’ বলেই মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।
এই ধরনের বক্তব্য বা অবস্থান নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্নটি আবারো সামনে নিয়ে আসে। সরকারি কর্মকর্তাদের এমন আচরণ অতীতে সরকারকে বিতর্কিত করেছে, এখনও করবে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন: আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বড় চ্যালেঞ্জ: সিইসি
যদিও তারা বলছেন, অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রশাসনকে ব্যবহার করার চিন্তা থেকেই দলীয়করণের বিষয়টি ছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের তেমন উদ্দেশ্য থাকার কথা না।
‘এমন ঘটনায় যদি অ্যাকশন না নেওয়া হয় তাহলে আজকে একজন বলেছে কালকে আরেকজন বলবে, এরপর একশ জন বলবে,’ বলে মনে করেন সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে।
বিশেষ করে অতীতের নানা পদক্ষেপে বিতর্কিত হয়ে পড়া পুলিশ ও প্রশাসনের সংস্কারে আলাদা কমিশনও গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা যা বলেছিলেন
জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে আলোচনা সভার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। যেখানে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং আহতদের সংবর্ধনা দেয়া হয়।
ওই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে জেলার পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, “আপনাদের ঐক্য যে বিনষ্ট করা হচ্ছে, এটা আপনারা খেয়াল করছেন না। আপনারা যদি এটা খেয়াল না করেন, শত্রুরা সুযোগ পেয়ে যাবে। শত্রুরা কিন্তু আবার আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মনে করতে হবে, এটা তাদের সাইবার ওয়ারফেয়ারের একটা অংশ। এই অংশকে আপনাদের প্রতিহত করতে হবে।”
মি. সানতু আরো বলেন, ‘আপনাদের সাথে সাথে প্রশাসনে আমরা যাঁরা রয়েছি, আমাদেরও কিন্তু একই পরিণতি বরণ করতে হবে। আপনাদের পরিণতি যদি সঠিক চান, দেশটাকে যদি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যদি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে মুক্ত করতে চান, অতএব আপনাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
‘আপনারা তাদেরকে, ষড়যন্ত্রকারীদের বলে দেবেন, আপা আর আসবে না, কাকা আর হাসবে না,’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এই বক্তব্য নিয়ে নানা মাধ্যমে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও রাজনৈতিক অনুগতরাই পুলিশ বা প্রশাসনের বিভিন্ন দায়িত্বে বসেছে কিনা। এছাড়া এই কর্মকর্তাদের অধীনে নির্বাচন কিভাবে নিরপেক্ষ হবে এ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন অনেকে।
যদিও রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এই বক্তব্য দেননি বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু। সমালোচিত হওয়ার মতো কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি বলেও দাবি তার।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, ‘আমি যেটা বলেছি ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্যে, কাউকে আসলে উদ্দেশ্য বা মেনশন করে বলি নাই। যারাই ষড়যন্ত্র করে, এটা প্রতীকী অর্থে বলা।’
তার বক্তব্যের ‘আপা আর আসবে না, কাকা আর হাসবে না’ এই লাইনটি “প্রতীকী অর্থে বলা বলেই দাবি করেন মি. সানতু।
তিনি বলছেন, অনুষ্ঠানে উপস্থিত জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজন এবং আহতদের প্রশ্নের ভিত্তিতেই এই বক্তব্য দিয়েছেন।
‘তাদেরকে সাহস দিতে বা ষড়যন্ত্র করার মতো কেউ আসবে না, এটিই বোঝানো হয়েছে। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা কারো ওপরে আঘাত দিয়ে বা কষ্ট দেয়ার জন্য এটা বলা হয়নি,’ বলেও দাবি তার।
ষড়যন্ত্র বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন বা কারা ষড়যন্ত্র করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য বিভিন্নভাবে কত কিছু করা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে, বিভিন্ন হামলা হুমকি দেয়া হচ্ছে, মানুষের যাতে আস্থা থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি, তারা যাতে ভীত না হয়, সেই আস্থাটাও মানুষকে আমাদের দিতে হবে।’
‘এর মধ্যে রাজনীতির কোনো বিষয় নেই’ বলেও দাবি করেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার।
সরকারি কর্মচারিদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, আইন কী বলছে
সরকারি কর্মচারীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়ার বিষয়ে স্পষ্ট বিধি-নিষেধ রয়েছে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায়। যার ব্যত্যয় ঘটলে প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়ারও সুযোগ রয়েছে।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ এর বিধি-২৫ (১)–এ বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে পারবেন না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনোভাবে যুক্ত হতে বা কোনো প্রকারে অংশগ্রহণ বা সহযোগিতা করতে পারবেন না।
এছাড়া বিধি–২৫ (৩)–এ বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী আইন পরিষদ নির্বাচনে কোনো প্রকার প্রচারণা অথবা অন্য কোনোভাবে হস্তক্ষেপ বা প্রভাব প্রয়োগ অথবা অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।
এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের বক্তব্য বা কোনো কর্মকাণ্ড এই বিধির আওতায় পড়ে কিনা সেই সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উঠলে সেই ব্যপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সরকারের বলেও উল্লেখ আছে ওই বিধিমালায়।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস কনডাক্টে কোনো সরকারি কর্মচারী যাদের জনগণের পয়সায় বেতন ভাতা হয়, তারা কোনো রাজনৈতিক সভা সমাবেশে অংশগ্রহণ করবেন না এবং কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে পারবেন না। যদি করেন তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়।’
‘এক্ষেত্রে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে নাকি এটা চলতে দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত সরকারের” বলেও উল্লেখ করেন মি. খান।
একজন সরকারি কর্মচারী কী করতে পারবেন, কী পারবেন না সেটা ১৯৭৯ সালের আচরণবিধিতে পরিষ্কারভাবে বলা আছে। চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের এই বক্তব্য তার ‘পরিষ্কার ব্যত্যয়’ বলেই মনে করেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান মোহাম্মদ নুরুল হুদা।
এক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানান মি. হুদা।
তিনি বলছেন, নিয়ম অনুযায়ী ওই মন্তব্য দেখে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পদক্ষেপ নেবে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় পদক্ষেপ নিতে তাকে বরখাস্ত অথবা উইড্রো করে বিভাগীয় কার্যক্রম চলতে পারে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপারের ওই বক্তব্য নিয়ে মি. হুদা বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘চাকরির একটা নিয়ম কানুন আছে যা অতি উৎসাহী অনেকে বুঝে না। এসব কথা বলার তো তার কোনো এখতিয়ার নাই। কে আসবে কে না আসবে সেটা তো জনগণ ডিসাইড করবে, এটা ওনার বিষয় না।’
সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়
সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেয়া কিংবা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বিতর্ক তৈরির নজির নতুন নয়। অতীতেও বিভিন্ন সরকারের আমলে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন পুলিশ বা প্রশাসনের অনেক কর্মচারী।
গত তেসরা জুলাই রাজধানীর আজিমপুর এলাকায় জামায়াতে ইসলামীর একটি অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ বিভাগের সহকারী কমিশনার শাহ আলম।
এর আগে ফেসবুকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেওয়ায় লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক সহকারী কমিশনার তাপসী তাবাসসুম ঊর্মিকে চাকরিচ্যুত করে সরকার।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এমন নানা অভিযোগ উঠেছিল।
গত বছরের ২০শে নভেম্বর পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী জাফর উল্যাহর সঙ্গে ফুলের তোড়া নিয়ে দেখা করেন তাঁর ছোট ভাই সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
গত বছরের ১১ই সেপ্টেম্বর, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য সরকারকে আবার ক্ষমতায় আনতে হবে, এমন বক্তব্য দিয়ে বিতর্কিত হন জামালপুরের জেলা প্রশাসক ইমরান আহমেদ।
এছাড়া কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার এক কর্মকর্তা সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে আবারও নির্বাচনে জয়ী করতে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতি ‘মিনতি’ জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল।
এভাবে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কিংবা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে নানা সময় বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন সরকারি কর্মচারীদের অনেকে।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলছেন, ‘অতীত, বর্তমান বিভিন্ন সরকারের সময় এটি হয়ে আসছে এবং সরকার এটাতে খুব মজা পায়।’
তবে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো কোনো দলীয় সরকার নয়। তাদের মজা পাওয়ার কিছু নাই সুতরাং তারা তো অ্যাকশন নিবে। যদি অ্যাকশন না নেয় তাহলে আজকে একজন বলেছে কালকে আরেকজন বলবে, এরপর একশ জন বলবে,’ বলেও মন্তব্য করেন মি. খান।